দ্রব্যমূল্য-রমজানে তো কমারই কথা by জহিরুল হক শাকিল

গত রমজানে আমি উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ড ছিলাম। সেখানে ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি অনেক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সেগুলোর একটি হলো রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত। সেখানে আমি দেখলাম অনেক পরিবারই রমজান মাসের দু'এক সপ্তাহ আগে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কম ক্রয় করেন।


উদ্দেশ্য রমজান মাস উপলক্ষে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার সুপার মার্কেট ও তরিতরকারির দোকানগুলোতে দ্রব্যমূল্যের ওপর বিশেষ ছাড় তথা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার সুযোগ নেওয়া। আমি সেখানে অনেক হিন্দু পরিবারকেও দেখেছি তারা রমজান মাসের ২ সপ্তাহ আগে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অপেক্ষাকৃত কম কেনেন। এ জন্য যে, রমজান মাসের সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর ওপর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে।
আবার অনেককে দেখলাম রমজান মাসের শেষ সপ্তাহে বেশি করে এসব পণ্যসামগ্রী ক্রয় করছেন। কারণ রমজান মাসের পর দ্রব্যমূল্য আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এ সুযোগটি মুসলমানরা যেমন গ্রহণ করছে পাশাপাশি অমুসলিম জনগণও এ সুযোগ থেকে উপকৃত হচ্ছে। সেখানে আমার এক নেপালি বন্ধু ছিল। নাম সিজান নিউপানি। সে আমাকে তো একদিন বলেই বসল_ তোদের যদি সারা বছর রোজা থাকত, তাহলে তো ইংল্যান্ডে আমার খাওয়ার খরচ ২৫ ভাগ কমে যেত।
এ হলো একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রমজান মাসের দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা। যে দেশকে কি-না আমাদের দেশের অনেক ইসলামী সংগঠন, রাজনৈতিক দল, অনেক ব্যক্তি ইরাক-আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য ইসলামের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে।
এবার আসা যাক আমাদের দেশের রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে। আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য রমজান মাস তথা রোজা ফরজ করার পেছনে অন্যতম মাহাত্ম্য ছিল, তার বান্দারা যেন অভুক্ত থাকার কষ্ট অনুভব করতে পারে। আর এ অভুক্ত থাকার কষ্ট থেকে যেন গরিব, অভুক্ত, যারা একবেলা পেটপুরে খেতে পায় না, তাদের প্রতি সারা বছর সদয় হয়। এ ছাড়া রোজার অর্থই হলো সংযম। এ মাসে একজন মুসলমান তার মনের কুপ্রবৃত্তির ওপর সংযম সাধন করবে। বেশি কথা বলা থেকে সংযম সাধন করবে, খাবার-দাবারে সংযমী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সে হিসাবে রমজান মাসে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম দেশে পণ্যসামগ্রী উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা, শাক-সবজি পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা, মাছ-মাংস নিয়ে বিক্রেতারা দিনভর ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করার কথা। আর এসব কারণে প্রতিটি রমজানে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেওয়ার কথা ছিল। যার জন্য সার্বিক অর্থনীতিতে এ মাসে ধস নামত। দেশের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী বাকি ১১ মাস টেনশনে থাকতেন কীভাবে রমজান মাসের অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করবেন।
হ্যাঁ। আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের সব যন্ত্রই রমজান মাসকে নিয়ে টেনশনে থাকেন। আর সে টেনশন হলো কীভাবে বাড়তি পণ্যসামগ্রীর জোগান দেবেন। দ্রব্যমূল্য মোকাবেলা করবেন। প্রতি বছরই রমজানের ৩-৪ মাস আগে থেকেই আমাদের দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে থাকেন। আসছে রমজানে কোনো দ্রব্যমূল্য বাড়বে না, জাহাজ সাগরে ভাসছে নোঙর ফেলবে বলে, পর্যাপ্ত পণ্যসামগ্রী মজুদ আছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবশেষে রোজা শুরুর ২-৩ দিন আগে শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যবসায়ীদের প্রতি করজোড় আবেদন, অনুগ্রহ করে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে রোজাদারদের কষ্ট দেবেন না। এভাবে তাদের হেদায়তের বাণী শোনানো হয়, ধর্মের মর্মবাণী শোনানো হয়। কিন্তু ... না শুনে ধর্মের কথা। এবার তো এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশে জেলা প্রশাসকদের নিয়মিত সম্মেলন রোজার আগে আয়োজন করা হলো। সেখানে সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ সবাই ডিসিদের প্রতি একটিই আহ্বান রেখেছেন। আর তা হলো ডিসিরা যেন দ্রব্যমূল্য ও ব্যবসায়ীদের কারসাজি মোকাবেলায় সদাজাগ্রত থাকেন। কিন্তু কোনো মেকানিজমই কাজ করে না কোনো রমজান মাসেই। ফলে প্রতিটি রমজানেই দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়ে। এ বছর তো আরও অভিনব কারসাজি বাংলাদেশ অবলোকন করল। যা হলো_ চিনি একেবারে বাজার থেকে উধাও বা গায়েব। আর তেল নিয়ে তো তেলেসমাতির শেষ নেই। ছোলা থেকে সব ধরনের ডাল, খেজুর, বেসন, বেগুনের দাম বেড়েছে প্রতিবারের মতো অস্বাভাবিকভাবে। এ প্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন হলো, একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে, যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সব কাজ যেখানে শুরু হয় মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে সে দেশে কারা দ্রব্যমূল্য নিয়ে কারসাজি করেন? বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্র এবং অবশ্যই মুসলিম রাষ্ট্র যেখানে প্রতিটি রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড ঘটে।
এদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মুসলমান। আর এদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ই ইসলামের মূল চেতনা ধারণ না করায় রমজান মাসে এখানে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রসহ রাজনৈতিক দল, সিভিল সমাজ কি একবার ভেবে দেখেছে যে, এদেশের শতকরা ১৫ ভাগ অমুসলিম মানুষ কোন অপরাধে একটি মাস বাড়তি মূল্যের বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবেন। তারা কোন অপরাধে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ছাড়বেন? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূলনীতির চরিত্র?

জহিরুল হক শাকিল :সহকারী অধ্যাপক
পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
mjahirul999@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.