আদালতপাড়া-বিচারপ্রার্থী নারীদের দুর্ভোগ by আকরামুল ইসলাম

অধিকার রক্ষার্থে রাষ্ট্র নারীকে দিয়েছে বিভিন্ন আইনি রক্ষাকবচ। কিন্তু একজন নারী যখন তাঁর অধিকার আদায় ও দুর্ভোগ লাঘবের শেষ ভরসাস্থল হিসেবে সেই আইনের শরণাপন্ন হন, তখন বিচারপ্রার্থী সেই নারীকে আবদ্ধ হতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগের বেড়াজালে।


মামলার বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করা তাঁর কাছে অথই সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতোই কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, প্রতিটি স্তরেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে নতুন নতুন সীমাহীন দুর্ভোগ। একজন নারীর পক্ষে এসব সমস্যা সামাল দেওয়া রীতিমতো দুরূহ। থানায় যাওয়া, মামলা করা, মেডিকেল পরীক্ষা, আদালতে দাঁড়ানো, মামলা চালানো—সবই নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। নিষ্ঠুর হলেও সত্য, যে আদালতকে নারী মনে করে তাঁর শেষ অবলম্বন, সেই আদালত অঙ্গনের পরিবেশ তাঁর জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, মামলার কারণে একজন নারী যতটা না ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন আদালত অঙ্গনে। পুলিশ, উকিল, মোক্তার, মুহুরি, দালালেরা যে যার মতো ফায়দা লুটে নিচ্ছেন এসব অসহায় নারী বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে। আর ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় ভুক্তভোগীরা মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছেন সব নিষ্ঠুর গঞ্জনা। বিচারপ্রার্থী নারীরা ভয়ে মুখ খুলতেই চান না। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জজ আদালত প্রাঙ্গণে গেলে দেখা মেলে এ রকম অসংখ্য বিচারপ্রার্থীর। তাঁরা কেউ বা এসেছেন নিজের মামলা করতে অথবা স্বামী-সন্তানের কিংবা কোনো আত্মীয়ের মামলা চালাতে। সায়মা খাতুন (ছদ্মনাম) তাঁদেরই একজন। পারিবারিক আদালতের সামনে কোলের সন্তান আর বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামলা করতে এসেছেন? করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন।’ জানতে চাইলাম কিসের মামলা? অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘ভরণপোষণের মামলা।’ উকিল ধরেছেন? ‘দালালের মাধ্যমে একজনকে ধরেছি।’ দালালকে কত দিয়েছেন? ‘তিন হাজার টাকা।’ এত টাকার কথা শুনে অবাক হই। কিন্তু কাহিনি অন্য। তিনি বলেন, ‘বাবা ছাড়া কেউ নেই, ঠিকমতো চোখে দেখেন না। আদালতের রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। প্রথম দিন আসার পর এক দালাল বললেন, তিনি ভালো উকিল ধরে দেবেন, কিন্তু তাঁকে অগ্রিম টাকা দিতে হবে। না বুঝেশুনেই রাজি হই। উকিলের সঙ্গে কথা বলার পর তিনি বাইরে এসে তিন হাজার টাকা চান উকিলকে দেবেন বলে। আমিও দিয়ে দিই, কিন্তু পরের তারিখ আসার পর উকিল টাকা চাইলে সেই লোককে টাকা দেওয়ার কথা বলি। উকিল জানান, তিনি কোনো টাকা পাননি এবং আমাকে উল্টো বকা দেন। কিন্তু ভাই, আমি তো অসহায়, অশিক্ষিত মেয়ে মানুষ। লোকে আমাকে ঠকালে আমি কী করব?
আরেকজনের নাম জাহানারা। তিনি এসেছেন যৌতুকের মামলায়। তিনি বলেন, ‘দূর সম্পর্কের এক ভাই তাঁকে মামলার কাজে সাহায্য করতেন। তাঁর মাধ্যমেই উকিলের সঙ্গে লেনদেন হতো। কিন্তু একসময় আমার কাছে টাকার ব্যাপারে সন্দেহ হয়। পরে উকিলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে পরিমাণ টাকায় উকিলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি টাকা ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো সদুত্তর তো দেননি বরং কোনো সাহায্য করবেন না বলে হুমকি দিয়ে চলে যান। অসহায় কণ্ঠে বলেন, ‘বাইরের লোকজন ঠকালে কষ্ট কম লাগত, কিন্তু নিজের মানুষ যখন অসহায়ত্বের সুযোগে প্রতারণা করে, তখন সেই দুঃখ কোথায় রাখব।’
গারদখানার সামনে কথা হয় এক মধ্যবয়সী মহিলার সঙ্গে। জানা যায়, তাঁর নাম শাহানা বেগম। বোনকে নিয়ে এসেছেন মাদক মামলায় আটক স্বামীর জামিন নিতে। জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকায় উকিল ধরেছেন? বললেন, ‘১০ হাজার টাকায়।’ কত দিনের মধ্যে জামিন করে দেবেন বলেছেন? ‘এক মাসের মধ্যে জামিন করে দেবেন বলেছেন, কিন্তু এখন দুই মাস হতে চলেছে। জামিন তো করাতে পারেননি উল্টো এখন আরও টাকা চাচ্ছেন।’ ‘আপনাদের সঙ্গে কোনো পুরুষ মানুষ নেই?’ জোরে দম ছেড়ে বলেন, ‘পুরুষ মানুষ থাকলে এত হয়রানি হতে হতো না। সহজ-সরল মহিলা পেয়ে সবাই আমাদের ইচ্ছামতো ঘোরাচ্ছেন।’ টিফিন বক্সে খাবার নিয়ে বসে ছিলেন মাঝবয়সী এক নারী। প্রায় বছর খানেক ধরে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা চলছে। হাজিরার তারিখ ছিল, তাই স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। জানালেন প্রায়ই খাবার নিয়ে আসেন। এ জন্য পুলিশকে টাকা দিতে হয়। কিন্তু পুলিশ মাঝেমধ্যে খাবার পৌঁছে দেয়, আবার দেয় না, ভালো খাবার দিলেও তার থেকে অর্ধেক রেখে দেয়। আরও জানালেন, আদালতের ভিড়ের মধ্যে তিনি কিছু দিন আগে তাঁর মুঠোফোন হারিয়েছেন। বলেন, ‘পুরুষের মতো তো আমরা ভিড় ঠেলে সামনে হাঁটতে পারি না, আবার কিছু লোক আছেন, যাঁরা মেয়ে মানুষ দেখলে ইচ্ছে করেই শরীরে ধাক্কা দিয়ে যান। আদালতে মহিলা মানুষকে দেখলেই লোকে মনে করে এ নিশ্চয় কোনো খারাপ মহিলা, তা না হলে তাঁরা মামলা করতে আসবেন কেন? নিজের অধিকার রক্ষায় আদালতে আসব, সেটা লোকজনের কাছে দোষ। নারী হয়ে জন্মানোই বোধহয় আমাদের জন্য পাপ।’ আদালত অঙ্গনের এসব দুর্ভোগের পাশাপাশি বিচারের ক্ষেত্রেও নারীরা শিকার হন দুর্ভোগের। যেমন, ধর্ষণ মামলার বিচার চাইতে গেলে একজন মহিলাকে জেরা করার সময় এমন সব প্রশ্ন করা হয়, যা অনেক নারীই আদালতভর্তি লোকের সামনে উত্তর দিতে লজ্জা পান। এ রকম লজ্জার ভয়ে অনেকে আদালতমুখী হতে সাহসই করেন না। তা ছাড়া পুরুষ আইনজীবী ধরার কারণে তাঁরা লজ্জায় অনেক গোপন কথা বলতে পারেন না। মামলা করতে এসে নারীরা ভুগছেন এ রকম হাজারো সমস্যায়। মামলা করা এমনিতেই দুর্ভোগের, আর একজন নারীর জন্য এই দুর্ভোগ শতগুণ বেশি। যেখানে তাঁর অধিকার পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল, সেখানেই তিনি অধিকার লঙ্ঘনের শিকার। নারী দিবস এলেই আমরা নারীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয়ে উঠি, কিন্তু তার পরের দিন থেকে সব চুপচাপ হয়ে পড়ে।

No comments

Powered by Blogger.