বীর মুক্তিযোদ্ধাঃ তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না- ৩৩২

স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক মুক্তিযোদ্ধাঃ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ দেখে তাহের আহমেদ মনে মনে ভাবলেন, দেশের দুর্দিনে চুপ করে বসে থাকবেন না।

প্রতিজ্ঞা করলেন, তাঁকে কিছু একটা করতেই হবে। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকলেন। ২৫ মার্চের আগ থেকে অসুস্থ বাবা হাসপাতালে। ঢাকার বাসাবোর বাড়িতে মাসহ তাঁরা সাত ভাইবোন। বড় ভাই তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বকাবকি করলেন। দমে গেলেন না তিনি। মা বুঝতে পেরে একদিন ১০০ টাকার দুটি নোট বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ‘যাও, আমরা বুঝি শেষ হয়ে গেলাম।’ মায়ের কথা শুনে তাহের আহমেদ মনে শক্তি পেলেন। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলেন ভারতের উদ্দেশে।
তাহের আহমেদ ১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজের বিএসসির ছাত্র ছিলেন। ভারতে যাওয়ার পর প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে যোগ দেন। মূর্তিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের ঢালু সাব-সেক্টরে। তিনি ঢালু সাব-সেক্টরের একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। বুরেরচর, নকলা, তেলিখালীসহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন।
বুরেরচর যুদ্ধে তাহের আহমেদ যথেষ্ট রণকৌশল প্রদর্শন করেন। শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের কাছে বুরেরচর। জামালপুরের বেগুনবাড়ি সেতু ধ্বংসের জন্য তাহের আহমেদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে। চরের পাশে ছিল রেলস্টেশন।
তাহের আহমেদরা বুরেরচরে অবস্থানকালে ট্রেনে সেখানে একদল পাকিস্তানি সেনা আসে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাদের আক্রমণের। পরিকল্পনামতো বেলা ১১টায় তাঁরা একযোগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনারা ছিল বেড়িবাঁধের পূর্ব পাশে। আর তাঁরা ছিলেন পশ্চিম পাশে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নেতৃত্বে অত্যন্ত সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যাহত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
এরপর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে নদীর পাড়ে সমবেত হয়। গ্রামবাসীর সহযোগিতা ছাড়া তাদের পক্ষে নদী অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। এ সময় তাহের আহমেদ একটি কৌশল প্রয়োগ করেন। তিনি কয়েকজন গ্রামবাসীকে বলেন নৌকায় করে পাকিস্তানি সেনাদের পার করে দেওয়ার ভান করতে। নৌকা যখন মাঝনদীতে যাবে, তখন তাঁরা আক্রমণ চালাবেন। এর আগে তিনি গ্রামবাসীকে সংকেত দেবেন। সে সময় তাঁরা পানিতে ডুব দেবেন।
তাহের আহমেদের এই কৌশল সফল হয়। নৌকা মাঝনদীতে যাওয়ামাত্র গ্রামবাসী পানিতে ডুব দেন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। তাঁদের আক্রমণে সব সেনা নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তাহের আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১।
স্বাধীনতার পর তাহের আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। মেজর পদ থেকে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার নিজ বাওড় গ্রামের ভূঁইয়াবাড়িতে। বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। বাবার নাম সাইদুর রহমান, মা তহুরুন নাহার চৌধুরী। স্ত্রী আনজুমা আখতার। তাঁদের দুই মেয়ে।
তাহের আহমেদ বললেন, ‘দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে। বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। নতুন প্রজন্ম এ অর্জন বুকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নেবে।’
সূত্র: তাহের আহমেদ বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন মুক্ত আসরের আবু সাঈদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১। ছবি: ওমর ফারুক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.