খুচরা বাজারে ভেজাল সারের আধিক্য by এ এম এম শওকত আলী

কয়েক দিন আগে একটি বাংলা দৈনিক খুচরা বাজারে ভোজাল সারের আধিক্যের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংবাদটি নিঃসন্দেহে তথ্যবহুল। এর ভিত্তি মৃত্তিকা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সাল থেকেই ভেজাল ও নিম্নমানের সার সম্পর্কে কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন নিয়মিত প্রেরণ করে।


২০১০-১১ সালে সার বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি প্রকল্পে কিছু দাতা সংস্থার সহায়তায় ক্যাটালিস্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক সার ব্যবস্থা কেন্দ্রের (সংক্ষেপে আইএফডিসি) সাহায্য গ্রহণ করে। এ প্রকল্পটির উদ্যোক্তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও প্রকল্পটির বিষয়বস্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্রভুক্ত। আইএফডিসির পরামর্শক দল প্রকল্পের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে ভেজাল ও নিম্নমানের সার বিপণনের ব্যাপকতার বিষয় অনুসন্ধান করার কাজ শুরু করে। এ অনুসন্ধান ছিল মাঠপর্যায়ে। এ কাজ করতে গিয়ে ওই পরামর্শক দল মৃত্তিকা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সব পূর্ববর্তী প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করেছিল। এতে দেখা যায় যে ২০০৪ সাল পরবর্তী সময়ের সব প্রতিবেদনেই ভেজাল সারের পরীক্ষিত নমুনার বিশ্লেষণ ভেজাল ও নিম্নমান সারের পরিমাণ প্রকাশিত সংবাদের প্রায় সমান ছিল। প্রকাশিত প্রতিবেদনে এক হাজার নমুনার বিশ্লেষিত ফলাফল ৫০ শতাংশ পাওয়া যায়।
পূর্ববর্তী প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতেই পরামর্শক দল কৃষি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। পরবর্তী পর্যায়ে কৃষি সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক পর্যালোচনা সভায় পরামর্শক দল কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশ আলোচনা করা হয়। সুপারিশের অন্যতম বিষয় ছিল সার নিয়ন্ত্রণ আইনের (২০০৬) যথাযথ প্রয়োগ। এ আইনটি ২০০৬ সালের হলেও প্রথমে ১৯৯৪-৯৫ এবং পরবর্তী ১৯৯৬-২০০১ সময়ে দুটি আইনি আদেশ জারি করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের আইনটি মূলত পূর্ববর্তী আদেশের অনুরূপ। এ আইনের কয়েকটি ধারায় ভেজাল বা নিম্নমানের সার বিপন্ন নিষিদ্ধ এবং এ বিধান অমান্য করলে কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা জরিমানার কথা বলা আছে। পরামর্শক দল মাঠপর্যায়ে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে যে সুপারিশ করে তা ছিল জেলা ও উপজেলায় মোবাইল আদালতের কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল করা। মোবাইল কোর্ট আইনের বিধান অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সার ব্যবস্থাপনা আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান প্রয়োগ করে এ অবস্থার উন্নতি করতে পারে। সুপারিশের মধ্যে আরো বলা হয় যে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে একটি নির্দেশ সব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠাতে হবে। খসড়া নির্দেশনামায় একটি ছকও সনি্নবেশিত করা ছিল। এ ছকের উদ্দেশ্য ছিল কোন জেলায় কতটি মামলা হয়েছে এবং কতজন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে বা খালাস পেয়েছে তার বিবরণ। সুপারিশটি কৃষি মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে। যথারীতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশও জারি করা হয়।
নির্দেশটি প্রতিপালনের প্রকৃত অবস্থা যাঁচাই করার লক্ষ্যে পরামর্শক দল আবার দক্ষিণ ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের ছয়-সাতটি জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা সভায় মিলিত হয়। এতে দেখা যায়, অন্তত একটি জেলাও এ নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত ছিল না। সূত্র মতে নির্দেশটি তারা পায়নি। তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি অনুসন্ধান ও পরে মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে একই তথ্য জেলাপর্যায়েও পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা কিছুটা গতিশীল করা হয়েছে। জেলা তথ্যের মধ্যে ছিল দস্তা সারসহ মিশ্র সারেই ভেজালের পরিমাণ অধিকতর। তবে সাম্প্রতিককালে জৈব সারসহ পটাশ ও এসএসপি সারেও এ বিষয়টি ধরা পড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যাদিও একই কথা বলেছে।
মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সার ব্যবস্থাপনা আইন প্রয়োগের জন্য বিদ্যমান অন্যান্য বিধিবিধানও অবশ্যই পালন করতে হয়। এসব বিধি-বিধানের পালনীয় বিষয় আলোচনার প্রয়োজন। এক, সার ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা পরিদর্শক হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তবে আইনে অন্য কোনো কর্মকর্তা বা ব্যক্তিকেও পরিদর্শকের ক্ষমতা সরকার ইচ্ছা করলে প্রদান করতে ক্ষমতাবান। তবে আজ পর্যন্ত এ ক্ষমতা অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি। কারণ অনুসন্ধানযোগ্য। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিদর্শকদের অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এক. এ বিষয়ে নজরদারি ছাড়াও সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের অন্যান্য বহুবিধ দায়িত্ব পালন করতে হয়। পরামর্শক দলকে এ কথা তাঁরা বলেছেন। দুই. এ দায়িত্ব পালনের জন্য অনেকেই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রোষানলের কোপে আক্রান্ত হয়েছেন। তিন. সরকার কর্তৃক নির্ধারিত একাধিক পরীক্ষাগার সারের নমুনা বিশ্লেষণের জন্য চিহ্নিত। অন্তত দুটি পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠানো হয়। প্রায়ই দেখা যায়, দুই পরীক্ষাগারের ফলাফল ভিন্নতর। একটি বলবে ভেজাল। অন্যটি বলবে ভেজাল নয়। এর ফলে যথেষ্টই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। দোষী প্রমাণিত করা সম্ভব হয় না।
নির্বাচিত একাধিক পরীক্ষাগারেরও সমস্যা রয়েছে। ঢাকার বাইরে এ ধরনের পরীক্ষাগারের সংখ্যা অপ্রতুল। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ছয়-সাতটি পরীক্ষাগার ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা সদরে রয়েছে। তবে এ বিষয়ে দুটি সমস্যা। এক. পরীক্ষাগারে উপযুক্ত লোকবলের অভাব। দুই. এসব পরীক্ষাগারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মাটির উর্বরতা বিশ্লেষণের জন্য উপযুক্ত। অর্থাৎ সারের গুণাগুণ নির্ধারণ করা এসব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এর ফলে ঢাকার বাইরের জেলার নমুনা ঢাকার কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারেই পাঠাতে হয়। যদিও মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে প্রেরিত নমুনা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্লেষণ করা হয়। বাস্তবে এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে এটা সম্ভব হয়েছে সে কথাও মাঠপর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা বলেছেন। এ জন্য তাঁরা মনে করেন নমুন পাঠানোর পর দ্রুত ফলাফল পাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ জরুরি। কাজের চাপে বা অন্য কোনো কারণে সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা এটা করেন না। বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও যুক্ত। নমুনা পাঠানোর পর তাঁরা মনে করেন আমার দায়িত্ব শেষ। ফলাফল আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ তাঁরা বিষয়টি রুটিন দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করেন।
একাধিক পরীক্ষাগারের ফলাফলে ভিন্নতার বিষয়ও কৃষিবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন। কারো মতে এর কারণ মূলত দুটি। এক. নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে পদ্ধতির ভিন্নতা, ভিন্নতার জন্যই ফলাফল ভিন্ন হয়। দুই. পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত রি-এজেন্টর নিম্নমান। প্রথমটির বিষয়ে পরামর্শক দল সব পরীক্ষাগারেই যাতে একই পদ্ধতি অনুসৃত হয় তা নিশ্চিত কারার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত সার বিশ্লেষণ ম্যানুয়াল সবাইকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। আশা করা যায়, এর ফলে পরীক্ষাগারভেদে নমুনা পরীক্ষার ভিন্নতা হ্রাস পাবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো মানসম্পন্ন রি-এজেন্ট সবাইকে ব্যবহার করতে হবে। এর মূল বাধা হলো সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি। এ আইন ও বিধি অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকেই ক্রয়াদেশ প্রদান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বাধা উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলকে বিষয়টির প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
পরামর্শক দলের প্রদত্ত সুপারিশের মধ্যে একটি অন্যতম সুপারিশ ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পেশকৃত বার্ষিক প্রতিবেদন যাতে এ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তার একটি স্থায়ী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। উদ্দেশ্য হলো এ বিষয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানই যাতে এ বিষয়ে যত্নবান হয় তা নিশ্চিত করা। এ সুপারিশের ভিত্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এ কমিটি অন্যান্য সদস্যের মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উপযুক্ত প্রতিনিধিরাও অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালকের (সরেজমিন) নেতৃত্বে একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ভেজাল বা নিম্নমানের সার বিপণন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়মিত পরীবিক্ষণ করা। আশা করা যায়, এ দুই পর্যায়ে পরীবিক্ষণ গতিশীল হলে অবস্থার কিছু উন্নতি হবে।
উলি্লখিত পদক্ষেপ ছাড়াও পরামর্শক দল মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর গতিশীলকরণের লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলসহ রাজস্ব বাজেট থেকে কিছু কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ভেজাল বা নিম্নমানের সার বিশ্লেষণের পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছে। এক গ্লাস পানির মধ্যে যেকোনো সার ঢেলে দিয়ে এর রং কী হয় তা দেখে সারের মান নির্ণয় করা সম্ভব। এ প্রতিষ্ঠানটি এ পদ্ধতি কৃষকদের ব্যবহারের জন্য একটি কিট (Kit) তাদের আগামী বছরের মধ্যেই পৌঁছে দেবে। এর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সহায়তা দেবে। প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর মাধ্যমে ভেজাল বা নিম্নমানের সার বিপণন প্রতিরোধ কার্যক্রমে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
« পূর্ববর্তী সংবাদ
       

No comments

Powered by Blogger.