সিলেট সওজঃ অর্থাভাবে শেষ হচ্ছে না তিন প্রকল্প, শঙ্কায় ছয়টি by উজ্জ্বল মেহেদী ও সুমনকুমার দাশ

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ রেখে বিকল্প মহাসড়ক পরিকল্পনায় সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় ১৯৯৮ সালে শুরু হয় ‘আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রকল্প’-এর কাজ। ২০০০ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এক বছর সময় বাড়ানোও হয়।

কিন্তু ১৩ বছরেও সড়কটি তৈরি করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। শুধু এ প্রকল্প নয়, অর্থাভাবে বারবার সময় বাড়িয়েও শেষ হচ্ছে না সওজের সিলেট-জকিগঞ্জ ও সিলেট জেলা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। একই কারণে সিলেট সওজের আওতাধীন ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কোনো প্রকল্পে ধাপে ধাপে অর্থবরাদ্দ হলেও নির্মাণসামগ্রীর ব্যয় বাড়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসছে না বলে জানিয়েছেন সওজ কর্মকর্তারা।
আঞ্চলিক মহাসড়ক: ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি থেকে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর-পাগলা-রানীগঞ্জ পর্যন্ত আঞ্চলিক মহাসড়ক তৈরির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। ২০০১ সালের জুন পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার সড়ক তৈরি হয়। সওজ কর্মকর্তারা জানান, এ কাজ সম্পন্ন করতে প্রাক্কলিত ব্যয় ১০০ কোটি টাকা শেষ হলে মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত অর্থবরাদ্দের আবেদন করা হয়। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার এলে ওই প্রস্তাব ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহাসড়কের নির্মাণাধীন অংশের কাজ শুরু হয়। প্রায় ছয় বছর আগে করা মহাসড়কের ৩১ কিলোমিটার অংশে সংস্কারসহ নতুন করে আউশকান্দি ও রানীগঞ্জে পাঁচ কিলোমিটার অংশে মাটি ভরাটকাজ শুরু হয়। এতে ব্যয় হয় আট কোটি ১৫ লাখ টাকা।
বর্তমান মহাজোট সরকার আসার পর ওই পাঁচ কিলোমিটারসহ ১৯ কিলোমিটার অংশের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে ২০০৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৫২ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়। এই বরাদ্দে আউশকান্দির আট কিলোমিটার ও রানীগঞ্জের ১১ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হবে।
সওজ সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আমান উল্লাহ বলেন, একনেকের অনুমোদনের ৫২ কোটি টাকার মধ্যে জগন্নাথপুরের রানীগঞ্জের জন্য ৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১৭ কোটি টাকা। বাকি রয়েছে আরও ২০ কোটি।
হবিগঞ্জ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক ইকবাল বলেন, ১৫ কোটি টাকার স্থলে নয় কোটি টাকা মিলেছে।
জেলা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প: ২০০৮-০৯ সালে ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জেলার ১৪টি সড়ক সংস্কার ও নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সওজ। কাজ শেষ হওয়ার কথা গত ডিসেম্বরে। প্রকল্পের আওতায় সিলেটের দরবস্ত-কানাইঘাট, রশিদপুর-বিশ্বনাথ, দাওদাবাদ-দাউদপুর-ভাদেশ্বর ও সারী-গোয়াইনঘাট সড়ক নির্মাণ করার কথা। এই চারটি সড়ক নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৬২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ২০১১ সাল পর্যন্ত ২৭ কোটি টাকা এবং চলতি অর্থবছরে নয় কোটি টাকা পেয়েছে সওজ।
অর্থসংকটে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়াতে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে স্থানীয় সওজ। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা জানিয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক: ১০১ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল দুই বছরের মধ্যে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কয়েক বছর প্রকল্পের অর্থবরাদ্দ বন্ধ ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে কাজ আবার শুরু হয়। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রকল্পে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সওজের একজন প্রকৌশলী বলেন, এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হবে।
শঙ্কায় ছয়টি প্রকল্প: এদিকে চাহিদার তুলনায় সামান্য অর্থবরাদ্দ পাওয়ায় ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ‘চারখাই-শ্যাওলা-বিয়ানীবাজার’ সড়কের তিন হাজার ৩০০ মিটার রাস্তা উন্নয়ন ও সাতটি সেতু নির্মাণের জন্য ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর কাজ আগামী বছর শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। কিন্তু গত অর্থবছর মাত্র আড়াই কোটি এবং চলতি অর্থবছরে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
দুই বছর আগে জেলার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক জরুরি পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৪৫ কোটি টাকা। আগামী জুনে সড়ক পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছে সওজ।
সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কে ১০টি সেতু নির্মাণে ২০০৯ সালে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু গত অর্থবছর পর্যন্ত ২১ কোটি টাকা ও চলতি অর্থবছরে মাত্র ছয় কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সিলেটের কাজীরবাজার সেতু নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৯৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের আংশিক টাকা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেওয়ার পর কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশে কাজ শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ১ মার্চ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কাজীরবাজার সেতু পরিদর্শন করে জানান, ‘আগামী এপ্রিল মাসে ফের কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে শেষ করা হবে।’ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে বর্তমানে ১৮৯ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরে মাত্র আট কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সওজ।
সিলেট সদর উপজেলার বাদাঘাট থেকে বিমানবন্দর সংযোগ সড়ক নির্মাণে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ মিলেছে। আগামী বছরের জুন মাসে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ ছাড়া অর্থাভাবে গোলাপগঞ্জ উপজেলার চন্দরপুল ও কুড়া সেতুর নির্মাণকাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলেন: সওজের একাধিক ঠিকাদার বলেছেন, প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের টাকা বরাদ্দে একাধিক ধাপ ও অর্থ ছাড়ে বিলম্ব করায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর ব্যয় বৃদ্ধি। আবার সরকারের পালাবদলের সঙ্গে প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা বদল, অর্থবরাদ্দ বন্ধ প্রভৃতি কারণেও কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সিলেটের সবচেয়ে বড় প্রকল্প আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ঝুলে থাকার কারণ ‘রাজনৈতিক’ বলে অভিহিত করেছেন জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কটি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদের প্রচেষ্টায় শুরু হয়। পরে চারদলীয় জোট সরকার এসে রাজনৈতিক কারণে পুরো প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। এ সরকারের আমলে কাজ শেষ না হলে আবার বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে ওই এলাকার (জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুল মান্নান আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ সড়ক বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি থাকায় আশা করছি, আগামী অর্থবছরের মধ্যে কাজ সমাপ্ত হবে।’
সিলেট সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিম বলেন, ‘প্রকল্পের অর্থ দ্রুত ছাড় দেওয়া হলে নির্মাণকাজ সমাপ্ত করতে কোনো বাধা থাকবে না। আমরা যেসব প্রকল্পে অর্থ পেয়েছি, তা দিয়ে যথাসময়ে পুরো কাজ শেষ করার উদাহরণ রয়েছে।’
সওজ সিলেট অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহ মো. মুসা বলেন, ‘ঝুলে থাকা প্রকল্পে আগের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে বর্তমান নির্মাণ ব্যয়ের অসামঞ্জস্য সমস্যা তৈরি করে। এসব সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনার পর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক হয়েছে। আশা করছি, এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.