এলপি গ্যাসের দামে রেকর্ড by অরুণ কর্মকার

তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাসের দাম রেকর্ড ছুঁয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। আর চলতি মাসে প্রতি সিলিন্ডারে বাড়ছে আরও প্রায় ২০০ টাকা করে। এ কারণে পাইপলাইনের গ্যাস ও এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীদের মধ্যে বৈষম্য ব্যাপক হয়ে উঠেছে।

এ বৈষম্য রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও সরকারের নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি মাসে প্রতি মেট্রিক টন এলপি গ্যাসের দাম (সিপি বা কন্ট্রাক্ট প্রাইস) উঠেছে প্রায় এক হাজার ৪০০ টাকা। এর সঙ্গে আমদানি করা গ্যাস বাজারজাত করা পর্যন্ত সিলিন্ডারপ্রতি মোট ব্যয় হয় আরও প্রায় ২৫০ টাকা। এর ফলে গ্রাহককে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাস কিনতে হবে প্রায় এক হাজার ৭০০ টাকায়।

এক বছর আগে, গত বছরের মার্চ মাসে ১২ কেজির এলপি গ্যাসের প্রতিটি সিলিন্ডারের কোম্পানি-নির্ধারিত দাম ছিল সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা। গ্রাহক পর্যায়ে তা আরও ৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
এ অবস্থায় দেশের জ্বালানি-পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনার জন্য এলপি গ্যাসের আমদানিকারকেরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার আমদানিকারকদের এক যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়।
গ্যাস-সংযোগ বন্ধের প্রতিক্রিয়া: দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকার নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখায় ঢাকাসহ সারা দেশের শহরাঞ্চলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এলপি গ্যাস। কোনো বিকল্প জ্বালানি না থাকায় এর চাহিদা বাড়ছে হু হু করে। এলপি গ্যাসের শিল্প ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত এক বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে এলপি গ্যাসের বিপণনকেন্দ্র বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। আমদানিও বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
সরকার এ চাহিদার কথা বিবেচনা করে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারজাত করার নতুন নতুন কারখানা স্থাপন, গ্রাহকের কাছে সহজলভ্য করা এবং ভর্তুকি দিয়ে হলেও দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিল। কিন্তু একটি পদক্ষেপও কার্যকর হয়নি।
এ কারণে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জ্বালানি ব্যবহারে নাগরিকদের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। যাঁরা পাইপলাইন গ্যাস-সংযোগের আওতায় আছেন তাঁদের প্রতি মাসে জ্বালানি খরচ সর্বোচ্চ সাড়ে ৪০০ টাকা। আর যাঁদের এলপি গ্যাস ব্যবহার করতে হয়, তাঁদের খরচ এই মাস থেকে হবে তিন হাজার টাকারও বেশি।
সৌদি আরামকোর সিপি: এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এলপি গ্যাস উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন সৌদি আরামকো প্রতি মাসের ১ তারিখে তাদের মালিকানাধীন এলপি গ্যাসের রপ্তানিমূল্য (সিপি) ঘোষণা করে। এলপি গ্যাসের দুটি উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন। এ বছর জানুয়ারি মাসে সৌদি আরামকো প্রতি টন প্রোপেন ও বিউটনের সিপি ঘোষণা করেছিল যথাক্রমে ৮৫০ ও ৯১০ মার্কিন ডলার। গত মাসে তা ছিল যথাক্রমে এক হাজার ১০ ও এক হাজার ৪০ ডলার। চলতি মাসের সিপি ঘোষণা করা হয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ২৩০ ও এক হাজার ১৮০ ডলার। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, এলপি গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি এবং মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা মূল্যবৃদ্ধির কারণ বলে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। ওই আমদানি মূল্যের সঙ্গে প্রতিটন গ্যাস আমদানির জন্য জাহাজ ভাড়া দিতে হয় ১৭০ ডলার। তাই সব মিলিয়ে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম পড়ে এক হাজার ৪০৮ টাকার ওপরে।
আনুষঙ্গিক ব্যয়: আমদানিকারকেরা জানান, সরকার চলতি বছরের বাজেটে এলপি গ্যাসের ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক ও কর তুলে দিয়েছে। এর পরও প্রতিটন এলপি গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে ‘পোর্ট ডিউজ’ দিতে হয় ২৫০ টাকা এবং ‘রিভার ডিউজ’ ৩৩ টাকা। এই দুইয়ের ওপর মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ। এ বছর থেকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) লাইসেন্স ফি দিতে হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। আগে থেকেই চলে আসা পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লাইসেন্স ফি এক লাখ টাকা। এ ছাড়া বিমা, ঋণপত্র খোলার ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ সিলিন্ডারপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় ২৫০ টাকা।
‘পথনকশা’য় এলপি গ্যাস: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি বছরের বাজেট পেশ করার সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে পথনকশা: একটি হালচিত্র শীর্ষক পুস্তিকায় দেশে এলপি গ্যাসের বিদ্যমান অবস্থা বর্ণনা করেছেন। এতে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে এলপি গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা তিন লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারি খাতে দেশে উৎপাদিত হয় ১৭ হাজার টন, আর বেসরকারি খাতে আমদানি করা হয় ৬০ হাজার টন।
অবশ্য বেসরকারি হিসাবে দেশে বর্তমানে এলপি গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। আমদানিও বেড়ে প্রায় ৮০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। তার পরও দেশে এলপি গ্যাসের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় এক-চতুর্থাংশের মতো।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা আরও বাড়ছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ বিবেচনা করে এবং গৃহস্থালি প্রয়োজনে গ্যাস-সংযোগের অপর্যাপ্ততা লক্ষ করে সরকারও এলপি গ্যাসের প্রসারে অঙ্গীকারবদ্ধ। অন্তত জ্বালানি কাঠ ও কেরোসিনের চাহিদা এলপি গ্যাস দিয়ে মেটানোর ব্যবস্থা নিতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ জন্য সরকার এলপি গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি ও ব্যবহার প্রসারের জন্য এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো প্রথম আলোকে বলেছে, অর্থমন্ত্রী যেসব ব্যবস্থার কথা বলেছেন, তার মধ্যে একমাত্র দাম পুনর্নির্ধারণ করলেই এলপি গ্যাসের দাম দ্রুত কমানো সম্ভব। অন্য সব ব্যবস্থাই দীর্ঘমেয়াদি। ফল পেতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে জ্বালানির সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে।
নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ থাকায় ঢাকাসহ অনেক নগর-শহরে মানুষ নতুন বাসাবাড়ির জন্য এলপি গ্যাসের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু তাঁরা গ্যাস পাচ্ছেন না। পেলেও দাম অত্যন্ত বেশি। মফস্বলের যেসব শহরে আগে থেকেই এলপি গ্যাস ব্যবহূত হচ্ছিল, সেখানেও চাহিদা বাড়ছে। অনেক গ্রামাঞ্চলেও এখন এলপি গ্যাসের চাহিদা আছে। ছোট ও মাঝারি ধরনের হোটেল-রেস্তোরাঁ, কিছু শিল্প এবং যানবাহন চলাচলেও এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে।
কারখানা স্থাপনে অগ্রগতি কম: এলপিজি বোতলজাত করার কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি কম। চলতি বছরের জাতীয় বাজেটে এ-সংক্রান্ত স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি এগোচ্ছে না। অথচ বিপিসি গত বছরের জুলাই মাসে আগ্রহী কোম্পানির কাছ থেকে আগ্রহপত্র নিয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে বিপিসির সূত্র জানায়, মোট ১৬টি কোম্পানি আগ্রহপত্র দিয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাইও করা হয়েছে। শিগগিরই প্রস্তাবগুলো পিপিপির অধীনে বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, বিষয়টি এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, সেখান থেকে বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেতে আরও অনেক সময় লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.