যুক্তি তর্ক গল্প-অদ্ভুত আঁধার কি নেমে আসছে? by আবুল মোমেন

যখন পুরো জাতি, বিশেষ করে তরুণসমাজ ও সৃজনশীল মানুষজন, দেশের দুজন গুণী মানুষের মর্মান্তিক-নিষ্ঠুর মৃত্যু নিয়ে এবং আরেকজন মারাত্মক আহত শিল্পীকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে, তখন কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীন আচরণ বড়ই অসংগত ও পীড়াদায়ক মনে হচ্ছিল।


তাঁদের দায় এড়ানো দায়িত্বহীন কথাবার্তা বেশি বাজছিল কানে ও বুকে। কারণ, যাঁদের নিয়ে সবার শোক ও ক্ষোভ, তাঁরা সবার প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন। একদিকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রেখে, আর অন্যদিকে সাধারণভাবে দেশ ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধের কারণে। তাঁদের মৃত্যুতে ক্ষতিটা এ কারণেই বড় যে এ দেশে সৎ, অঙ্গীকারবদ্ধ ও দায়িত্বশীল মানুষের বড় অভাব—শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যেও। তারেক-মিশুকরা শিল্প তৈরির পাশাপাশি মানুষ তৈরি করতেন। ঢালী আল মামুনের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।
এই বেদনায় যখন জাতি কাতর, তখন তাদের শুনতে হচ্ছে মন্ত্রীদের ব্যর্থতার সাফাই আর দেখতে হচ্ছে দায়িত্ব এড়ানোর গোঁয়ার্তুমি। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনাতেই এই মৃত্যু ও জাতীয় ক্ষতি এবং ক্রমেই এই ক্ষতির থাবা বেড়েই চলেছে। তাই স্বভাবতই মানুষ সড়ক ও চালক নিয়ে কথা তুলছে। জনপথের অবস্থা শোচনীয়, তদুপরি চিহ্নিত বিপজ্জনক বাঁকগুলো ঠিক করার কাজ হয়নি। তার ওপর জানা গেল, কীভাবে স্বল্প অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণহীন নবিশদের পাকা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। খবর অনুযায়ী, নৌপরিবহনমন্ত্রী পরিবহন শ্রমিকনেতা হিসেবে এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাজটা বেআইনি, বহু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সমতুল্য কাজ এবং এতে হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। যোগাযোগমন্ত্রী কেবলই দায় এড়াতে চাইলেন এবং করছি-করব ভাব করে গেলেন। আর নৌপরিবহনমন্ত্রী নিজের অকর্মকেই জায়েজ করে নিতে চাইলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে গা-জোয়ারি ভাব দেখিয়ে।
কিন্তু কথা হলো, মানুষ বুদ্ধি হারায়নি, বিবেকও নয়। ক্ষমতার অন্ধ দাপটের কারণে সে হয়তো চুপ থাকে, কিন্তু সে বিচারক, তার বিচারের ফল সে দেবেই। তাই গণতন্ত্রে নিয়ম হচ্ছে, মানুষের কথা শোনা, সমালোচনায় সংশোধন হওয়া, ব্যর্থতা-দুর্নীতির দায় স্বীকার করা।
ক্ষমতাবানেরা যখন দায়দায়িত্ব এড়াতে থাকেন, তখন মানুষের কি কিছু পাওয়ার থাকে? মানুষ দেখল, মন্ত্রী মহোদয়ের ক্ষমতা আর আত্মবিশ্বাস এত বেশি যে পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতারও তোয়াক্কা করেন না। দক্ষতা-অদক্ষতার ভেদরেখা মুছে ফেলে পরীক্ষার প্রতিবন্ধকতাটাও সরিয়ে দিতে চান।
অঘটন তো দেশে ঘটেই চলেছে। রমজানে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, হাইওয়েগুলো কেবল বিপজ্জনক রয়ে গেল তা নয়, গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, নীরব ও সরব চাঁদাবাজি চলছেই। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা কেবল বাড়ছেই, গ্রামে-মফস্বলে নারী ও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার থামছে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নেওয়া আর ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থার বিপরীতে সাধারণ মানুষের আশু প্রয়োজনগুলো অপূর্ণ থাকলে ভোটাররা সন্তুষ্ট থাকবেন কি? সরকার কৃষি ও শিক্ষায় ভালো কিছু কাজ করেছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ সরকারের ভূমিকা ভালো। কিন্তু এসব ভালো বিফলে যাবে, যদি না জনগণের আশু প্রয়োজনগুলো মেটানো যায়। নিত্যদিনের কাজ তো খাবার কেনা, কাজে যাওয়া, চিকিৎসা নেওয়া, ছেলেমেয়ে-স্ত্রীসহ নিরাপদে বাঁচা, একটু বিনোদন।
এই চাহিদাগুলো মেলাতে নাগরিকেরা কিন্তু হিমশিম খাচ্ছেন, পদে পদে সমস্যায় পড়ছেন। সবার মনের মধ্যে অনেক নালিশ জমছে। কর্তারা যদি সেসব না শোনেন, দায়দায়িত্ব এড়াতে থাকেন, তাহলে নালিশ থেকে ক্ষোভের বারুদ জমা হবে মনে। ২০০১-এর বিজয়ের পর বিএনপির বধির-গোঁয়ার নেতারা টের পাননি, তাঁদের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে কতটা ক্ষোভ জমেছিল। বিপুল পরাজয়ের পরও কি টের পেয়েছেন?
রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় যেতে চান ক্ষমতা ভোগ করার জন্যই, ‘আর্ট ফর দ্য আর্ট সেক’-এর মতো। দেশসেবার বুলি ভোটারদের ভোলানোর দাওয়াই মাত্র। ক্ষমতা ওঁরা ভোগ করুন তাতে কারও আপত্তি নেই, কিন্তু সেটাকে হালাল করে নিলেই তো হতো—জনগণের প্রয়োজনটুকু মেটানো হোক, ধাপে ধাপে হোক, ধীরে ধীরে হোক।
এ সরকারের আড়াই বছর চলে গেছে, ৫০ ওভারের খেলার অর্ধেক শেষ, প্রথম দিকে রান উঠেছিল কিছু, ওয়ানডের ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের মতো, হানিমুন পিরিয়ড কেটেছে তখন। কিন্তু এখন দ্রুত কয়েকটা উইকেট যে পড়ে গেল। সৈয়দ আবুল হোসেন, সাহারা খাতুন, শাজাহান খান বা ফারুক খানরা মন্ত্রিত্ব আঁকড়েই থাকবেন? তা থাকুন। কিন্তু জনগণের দরবারে তাঁদের উইকেট পড়ে গেছে। তাঁরা এবং আরও কেউ কেউ শেখ হাসিনার দরবারেই শুধু থাকছেন—তবে কোন দরকারে, সেটা সমর্থকেরাও বুঝতে পারছেন না।
বলা দরকার, মন্ত্রিসভার অনেকের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়েছে, অনেকের ওপর আস্থা টলেছে। না, এর অর্থ এই নয় যে তারা বিএনপিতে আস্থা খুঁজছে বা পাচ্ছে। ভয়ের কথাটা হলো, মানুষ ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়ছে। এ সরকারকে তো উজাড় করে দিয়েছিল তারা, বিএনপির অপশাসনে তিক্ত-বিরক্ত মানুষ বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ কি জনগণের দল হিসেবে থাকতে পারল? যদি মন্ত্রী, সাংসদ, দলীয় নেতারা ক্ষমতাই বোঝেন, দায়িত্ব না বোঝেন, দায় গ্রহণের দায় না মানেন, তাহলে মানুষের তো মনে হবে, জ্বলন্ত চুলা থেকে তপ্ত তাওয়ায় গিয়ে পড়েছে তারা।
এদিকে দলের কতজন ক্ষমতামদমত্ত সাংসদ ও নেতা মারপিটের সংস্কৃতি চালু করেছেন, সেটা দেখার কেউ নেই। তাঁরা ক্ষমতাবান, তাই মারেন, কখনো মারান। বাধা না পেয়ে, অর্থাৎ আশকারা পেয়ে, এ রোগ মহামারি আকারে বেড়ে চলেছে।
এভাবে চলতে চলতে একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটতে চলেছে। রাজনীতি, গণতন্ত্র, সংসদ, মন্ত্রিসভা, বিচারালয়, প্রশাসন—দেশের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ এসবের কাগুজে মূল্য থাকলেও বাস্তব মূল্য হারিয়ে যাচ্ছে। আরও ভয়ানক হলো, মানুষ মানুষের ওপর এবং সব প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। ইসলাম-ইসলাম জপছি বটে, নানা আড়ম্বরে নিজেদের ধার্মিক প্রমাণ করতে চাইছি বটে, কিন্তু অবিশ্বাসী কী করে বিশ্বাসী হবে? ইসলামের গোড়ার কথা তো বিশ্বাস।
এই যে একদিকে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছি, আর অন্যদিকে বিশ্বাস করতে ও বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি—এসবই মানুষের জন্য অধর্ম। অধর্ম থেকে ভালো ফল আসতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ জন্মদিনের ভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’-এ সভ্যতা, বিশেষত পশ্চিমা সভ্যতার ওপর বিশ্বাস টলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। বড় আশা করে বলেছিলেন, পূর্ব দিগন্ত থেকেই নতুন সূর্যের উদয় হবে, মানুষকে আবার আস্থা ও বিশ্বাসের জগতে ফিরিয়ে নেবে, বাঁচবে সভ্যতা।
কিন্তু এই পূর্ব দেশে আমরা অবিশ্বাসের সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি জোরেশোরে। রবীন্দ্রনাথের অমর নাটক ডাকঘর-এর নায়ক বালক অমলের চিরপ্রস্থানের সময় তার পিসেমশাই কথা বলতে গেলে ঠাকুরদা ধমকে বলেছিলেন, ‘চুপ করো, অবিশ্বাসী’।
আমরা কণ্ঠ উঁচিয়ে কাউকে এ ধমকটা দিচ্ছি না। তবে ভেঙে পড়ার আর তলিয়ে যাওয়ার এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে নিশ্চয়ই আকাশে-বাতাসে তাঁর এই কথাটা ধ্বনিত হচ্ছে।
প্রায় ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ দার্শনিক এ এন হোয়াইটহেড বলেছিলেন, আধুনিক মানুষ সাবজেক্টিভিটি হারিয়ে ফেলছে। আমাদের ক্ষমতাবানেরা এমনই আত্মহারা মানুষ যে আত্মা হারানোর ব্যাপারটা টেরই পান না। তাঁদেরই আধুনিক ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট বলেছিলেন ‘ফাঁপা মানুষ’!
ক্ষমতায় বসে গা-জোয়ারি কথা বলা সহজ, সমালোচনা, অভিযোগকে পাত্তা না দিলেই তক্ষুনি কিছু হয় না। কিন্তু দায়মুক্ত ক্ষমতা তো ভোগের বস্তু। অজান্তে ক্ষমতাবানেরা ভোগে লিপ্ত হন, ক্ষমতার অনুগ্রহপ্রার্থী স্তাবক তৈরি করে দৃষ্টিকে আড়াল, বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত আর বিবেককে নির্জীব করে দিতে পারেন।
ক্ষমতা তাই দৃষ্টিহীন, অন্ধ। শেখ হাসিনার শাসন কি সেই জীবনানন্দীয় অদ্ভুত আঁধার নামিয়ে আনল, যখন যারা অন্ধ, তারাই চোখে বেশি দেখে।
বাংলাদেশের মানুষ দৃষ্টিহীন-বধির ক্ষমতার হাতে বহুবার নাকাল হয়েছে, অনেক খেসারত দিয়েছে। লক্ষ্য হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, ঠিকই আছে। কিন্তু পুরোনো সমাজ, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধরে রেখে এ লক্ষ্য পূরণ কি সম্ভব? মৌলবাদী জঙ্গিদের দমিয়ে রাখবে হয়তো রাষ্ট্রশক্তি, কিন্তু অন্ধ ক্ষমতা তো চিন্তার মুক্তি দেবে না, বরং সমাজকে চিন্তার দিক থেকে আড়ষ্ট ও বদ্ধ করে রাখবে। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট লিখেছেন, পরিণত সমাজ হলো সেটি, যেখানে সংশয় প্রকাশের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে। জিজ্ঞাসু মন, প্রশ্ন করা মানুষ, তর্ক-তোলা সমাজ না হলে সে সমাজ এগোয় না। তার চিন্তায় ও মানসজগতে স্থবিরতা নামে, জং ধরে, তৈরি হয় অচলায়তন। সমাজমানস হয় বুড়িয়ে যায়, নয় বালখিল্যতায় হাস্যকর হতে থাকে। সেই স্থবির মনও ক্ষমতার দৌড়ে টিকতে নানা চমকপ্রদ কথা আর ধারণা হাজির করে চমকে দিতে পারে। কিন্তু সমাজ-মনের মুক্তির পথ খুলে না দিলে এসবই আখেরে কথার কথা থেকে যাবে, এর বেশি কিছু হবে না। অনুকরণ তো অনেক প্রাণীই করে, তারা মানুষ নয়, সৃষ্টির সেরা জীব নয় বলেই তা করে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.