ফিশারিঘাটের ব্যস্ত সকাল by নিয়াজ তুহিন

ভোরের আবছা আলো সবে ডালপালা মেলছে। নগরবাসী শেষপ্রহরের অঘোর ঘুমে। কিন্তু এই সাত-সকালে নগরের ফিশারিঘাটে যেন রাজ্যের ব্যস্ততা। চারদিকে গম গম করছে মানুষ। হাঁক-ডাক, চিৎকার-চেঁচামেচি। ফিশারিঘাট নাম শুনে এতক্ষণে হয়তো বোঝা যাচ্ছে ব্যস্ততাটা কিসের? হ্যাঁ, মাছ বেচাকেনার। এটি ঘাটের নিত্যদিনের চিত্র।


ভোর চারটা থেকে বিরামহীনভাবে চলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
প্রতিদিন নগরের মাছের বেপারি, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারাও একবার ঢুঁ মারেন এখানে। ফলে সকাল থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতায় ঠাসা থাকে। ট্রাক, টেম্পো, রিকশা ও ভ্যানে করে টনে টনে আসে মাছ। আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে আড়তদারের লোকজন মাছ নামিয়ে নিতেই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্রেতারা। শুরু হয় দরকষাকষি। এরপর মাছ নিয়ে চলে যান যে যার গন্তব্যে।
জানা যায়, ফিশারিঘাটে বর্তমানে ৮০টি আড়ত রয়েছে। এই সব আড়তদারেরা মূলত কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। মাছচাষি ও ব্যাপারীরা বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ এনে আড়তদারদের কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।
ফিশারিঘাট যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বলেন, ‘ফিশারিঘাটে মাছ ব্যবসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেড় লক্ষাধিক লোক জড়িত। এখানে খুলনা, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, মিরসরাই, লোহাগাড়া, চকরিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফের মাছ আসে। এমনকি ভারত ও মিয়ানমার থেকেও মাছ আসে এই ফিশারিঘাটে। মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, পোয়া, কই, তেলাপিয়া, মাগুর, পাঙ্গাশ বিভিন্ন প্রজাতির কার্প জাতীয় মাছ ও সামুদ্রিক মাছ অন্যতম। বর্তমানে সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ কম হলেও বর্ষায় বেড়ে যায়।
মািয়ানমার থেকে আনা ১০ টন রুই মাছ বিক্রি করতে এসেছেন মাসুদ ব্রাদার্স ফিসের মালিক মো. মাসুদ। তিনি বলেন, ‘ফিশারিঘাটে আনার সঙ্গে সঙ্গে মাছ বিক্রি হয়ে যায়। বেশি বেগ পেতে হয় না।’ এদিকে, সাতক্ষীরা থেকে দুই মণ পাঙ্গাস মাছ এনেছেন আলী আকবর। আবার মিরসরাই থেকে আবদুল মালেক নিয়ে এসেছেন তেলাপিয়া ও মাগুর মাছ। এভাবে বিভিন্ন স্থানে থেকে মাছ নিয়ে এসেছেন অনেকে। তাঁদের কেউ সবটুকু আড়তদারের কাছে বিক্রি করেন আবার কেউ পাইকারের কাছে বিক্রি করেন।
খুচরা বিক্রেতা মুহাম্মদ আলী কিনেছেন ২০ কেজি রুই মাছ ও ১০ কেজি লইট্যা মাছ। শহরের রাস্তায়-গলিতে ঘুরে ঘুরে তিনি এসব মাছ বিক্রি করবেন। প্রতিকেজি রুই মাছ কিনেছেন ৮০ টাকা আর লইট্যা ৪৫ টাকায়। তিনি বলেন, এখান থেকে মাছ কিনে বিক্রি করলে লাভ ভালোই হয়। তবে দিন দিন বাজারে মাছের পরিমাণ কমছে। এভাবে চলতে থাকলে মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জলিল বক্স সওদাগর আড়তের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘এখন সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ একেবারে কম। সমুদ্রে নৌকা-ট্রলার ডাকাতি ও মাঝি-মাল্লা হত্যার কারণে জেলেরা মাছ চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। অনেকে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আর এর প্রভাব পড়ছে বাজারে।’
শুধু যে বিক্রেতারা মাছ কিনতে যান তা নয়। অনেকে বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের জন্যও মাছ কিনেন এখান থেকে। দামে সাশ্রয়ী বলে সাধারণ ক্রেতারাও ভিড় জমান।
এই বাজার কীভাবে গড়ে উঠল? এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি রাজমোহন দাস (৮১) জানান, আগে ফিশারিঘাট এলাকা ছিল ডোবা ও চাষের জমি। ১৯৫৪ সালে সর্বপ্রথম নিকুঞ্জবিহারি জলদাস ও যামিনী রঞ্জন জলদাস এই বাজারে মাছ বিক্রি শুরু করেন। তখন এটি আঞ্জুমাঝির ঘাট নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ সালে এরশাদের শাসনামলে নাম পরিবর্তন করে ফিশারিঘাট রাখা হয়। এর সঙ্গে বাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়নও করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.