চরাচর-চবি : নিঝুমপুরীতে ভয়ের তাড়া by রাজীব নন্দী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সংঘাতময় পরিস্থিতিতে দুজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে, থেঁতলিয়ে, মাথায় গুলি ঠেকিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থীরা হল ছেড়েছে। মাসব্যাপী বন্ধের পর ১৭ মার্চ থেকে ক্যাম্পাস আবারও সচল হতে যাচ্ছে।


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং আড়াই বছর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে এই হত্যাযজ্ঞ এবং পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাস অচল করার ঘটনা অন্য দশজন মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের মতো আমাকেও বিচলিত করেছে। এই হত্যাযজ্ঞের অনুপুঙ্খ তদন্ত অবশ্যই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ কমিটি সব ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক সম্পন্ন করেছে। বর্তমান লিয়াজোঁ কমিটি সব ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে গেছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি ইতিবাচক দিক। এর জন্য উপাচার্যের আন্তরিকতা ও প্রশাসনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এর আগে একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে দেখেছি, তদন্তের ফল প্রকাশের আগে পারস্পরিক হিংসার কার্যকারণ সূত্র সম্পর্কে এবং ঘটনা ঘটার অব্যবহিত পরেই মন্তব্য এবং সিদ্ধান্তের প্লাবন বয়ে গেছে। আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করার প্রাচীন অভ্যাসটি অবাঞ্ছিত রক্তপাত ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যকার সংঘাতকে আরো উসকে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন ডান-বাম সব ছাত্র সংগঠনকে ডেকেছে। করণীয় নির্ধারণে সবার মতামত জানতে চেয়েছে। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পর দৃশ্যত ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর উৎপাত হ্রাস পেয়েছিল। ৯ মাস আগে কোন বিভাগে সবচেয়ে বেশি সেশনজট- এ রকম সংবাদ সংগ্রহের আশায় আমরা যখন অনুসন্ধান করছি, তখন দেখেছি কম্পিউটার সায়েন্সেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ একাধিক বিভাগ সেশনজটমুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। একসময়কার ধর্মান্ধদের কারণে ক্যাম্পাসে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীরদের নামও উচ্চারণ করা যেত না, সেই ক্যাম্পাসে এখন প্রশাসনের উদ্যোগে মাস্টারদা সূর্যসেনের ৭৮তম ফাঁসি দিবস মহাসমারোহে পালিত হয়েছে। হালদা নদীর গবেষণায় দক্ষিণ এশিয়ার গৌরব পুরস্কার, বিরল প্রজাতির অর্কিড ও বন্য প্রাণী (নতুন প্রজাতির ব্যাঙ) গবেষণা এবং কম্পিউটার সায়েন্সেসে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ঘটনা সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে। হামলা-সংঘর্ষ-দুর্নীতির বিপরীতে এসব 'সুখবর' একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এত সব সুখবরকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য দুই ছাত্র সংগঠনের লড়াই তো যথেষ্ট! কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনা কি অপ্রত্যাশিত? অহেতুক? আকস্মিক? এসব প্রশ্নের উত্তর পাহাড়সম। ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আবার গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। আবার রক্ত ঝরল। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়।
যাদের হত্যা করা হচ্ছে, যিনি ছিনতাই হলেন, যিনি আহত হলেন, যিনি নির্যাতিত হলেন- সে তো- এই, 'এই আমি নই' আত্মতুষ্টিই আঠারো হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতির নতুন নতুন মাত্রা যোগ করে। যে ভয়ের সংস্কৃতির মাধ্যমে ঘনিয়ে আসে নীরবতা; আর নীরবতার নোনা জলে বেড়ে ওঠে সন্ত্রাসের বীজ। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে ভয়ের সংস্কৃতি, তা নিপাত যাক। সব কিছুর ঊর্ধ্বে চাওয়া শুধু একটা- পাহাড়, সমতল আর ঝরনাধারার কোলে 'জ্ঞানরাজ্যের নিঝুমপুরী'খ্যাত প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভীতিমুক্ত থাকুক! রাজীব নন্দী

No comments

Powered by Blogger.