যা কখনও গ্রহণীয় হয় না by রণজিৎ বিশ্বাস

এমন কিছু ভাবনা আজকাল মনে আসছে, ঠেকাতেও পারছি না, আবার ভালোও লেগে যাচ্ছে। তারেক মাসুদের দেহের খাঁচা যেদিন এফডিসিতে নেওয়া হলো, সেদিন কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে যারা ক্রোধের ও ক্ষোভের কথা বললেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, আরেকজন গীতিকার টার্নড ইনটু প্রডিউসার-কাহিনীকার-ডিরেক্টর এবং আরও অনেক কিছু। কখনও কখনও টেলিভিশন প্রোগ্রামের অ্যাংকারও।


প্রথমজন মুক্তিযুদ্ধকে একাধিকবার চলচ্চিত্রে এনেছেন, একেবারে খারাপও আনেননি; কখনও কখনও মনকে তিনি ছুঁয়েছেনও। সেই মনই তাকে কান্নাকান্না অ্যাকশনে দেখে বলল_ লাভ কী! করে তো মুক্তিযুদ্ধের যারা অপমান করে, তাদের সংগঠন।
এ রকমই আমার মনে হয় স্বাধীনতার দুশমনদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া ছদ্মদুশমনদের দেখে। ভালো ও পবিত্র কাজের সঙ্গে তারা যায় না। না যাওয়া এই লোকদের মধ্যে যখন মিলে যায় কোনো খেতাবি মুক্তিযোদ্ধা, তখন হৃদিমধ্যে ক্রোধের বিস্তার ফুলে ওঠে ফেঁপে ওঠে। কোনোভাবেই মনে হতে চায় না যে, এরা মন লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে অথবা মুক্তিযুদ্ধ করা উচিত ছিল। কোনো অসুবিধাই হতো না এরা যদি রাজাকারের দলে থাকত। খেতাব পাওয়া এ ধরনের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমি চিনি, যারা আমাদের বড় অপমান ও বিরক্ত করতে শুরু করেছেন। একজন রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত করার দাবিতে যাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন, এখন ভয়াবহভাবে তাদের সঙ্গে গিয়ে মিশেছেন ও তাদের কোলে গিয়ে মিশেছেন।
দ্বিতীয়জন টেলিভিশনের এক টকশোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে বলেছেন_ আমি তো জানি না অমুক যুদ্ধাপরাধ করেছে কি-না; সমুকের হাতে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগি্নসংযোগ হয়েছে কি-না; আমার তো জানা নেই তমুকের বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণের অভিযোগ সত্য কি-না, সে পারঙ্গমতা তার আছে কি-না।
তখন আমি শুনেছি আর লজ্জা পেয়েছি। লজ্জা পেয়েছি আর ক্ষুদ্র হয়েছি। মনে হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা যখন এ কথা বলছেন, তখন বুঝতে হবে মাথায় পচন ধরেছে। এ পচন রোখাও যাবে না, এ পচন ভোগাবেও। মাথায় যখন পচন ধরে, দেহের পচন ঠেকানো যায় না।
হতাশায় হাত-পা এলিয়ে যখন এসব ভাবছি, তখন মনের আরেক কোণ থেকে হুঙ্কার উঠল_ কে বলেছে তোমাকে এ পচন রোখা যাবে না! এ পচন খুব ভালোভাবেই রোখা যাবে। কারণ এটি কোনো বিবেচনাতেই মাথায় পচন নয়। যে মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার-আলবদর, মৌলবাদী আর যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে দাঁড়ায়; তাদের বিচারে প্রতিবন্ধক হয়, সে লোক কখনও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। সমাজ ও জাতির মাথা সে নয়; কলঙ্ক। কলঙ্ক যখন কথা বলে, সে কথা কেউ শোনে না। মানুষ বলে_ ওকে তো চিনি, ভালো কথা ওর মুখ থেকে আর কী বেরুবে?! বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধার দলে নাম লেখানো কোনো মানুষ মানুষের কথা বলতেও পারে না, মানুষের পাশে দাঁড়াতেও পারে না।
সংসারে কিছু কিছু ভূমিকা আছে, কেউ কেউ কখনও গ্রহণই করতে পারে না। যদি করে, পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। যেমন রাজাকারের মুখে স্বাধীনতার কথা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীর মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা, সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক মানুষের মুখে ঔদার্য ও নিরপেক্ষতার কথা, অশিক্ষিত অনুদার ও রুচিহীন মানুষের মুখে রবীন্দ্রনাথের কথা এবং বার্থ-ডে জালিয়াত ও অর্থকালিয়াতের মুখে সততার কথা।

রণজিৎ বিশ্বাস :শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.