রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়-অবকাঠামোয় এগিয়ে, কোর্স চালুতে পিছিয়ে by তুহিন ওয়াদুদ

সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ব্যবস্থাপনায় যে শিক্ষায়তন রয়েছে তাতে সিংহভাগ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুনভাবে গড়ে উঠছে সেগুলোতে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন


রাজধানী থেকে দূরবর্তী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে ওঠা রংপুর বিভাগে জনসংখ্যার তুলনায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বড়ই অপ্রতুল। সরকারিভাবে দীর্ঘদিন ধরে রংপুরের উচ্চশিক্ষার চাহিদা সামান্য পরিমাণে পূরণ করে আসছে রংপুর মেডিকেল কলেজ এবং কারমাইকেল কলেজ। এ ছাড়াও রংপুর সরকারি কলেজ এবং রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজেও সম্মান এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পাঠদান করা হচ্ছে। মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। রংপুরে সরকারি যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে নামমাত্র। সীমাহীন সীমাবদ্ধতা সেগুলোর শিক্ষাকে বিকশিত করতে দেয় না। আর তা ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। রংপুরে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শুধু একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করলেই উচ্চশিক্ষা বিস্তারের কাজ করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রশাসন, এলাকার জনগণ এবং সরকার_সবার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান সৃষ্টি করা হয় এবং সেই জ্ঞানের অনুশীলন করা হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে গবেষণার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গত ৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থায়ী ক্যাম্পাস উদ্বোধনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি একাডেমিক ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। আরও দুটি একাডেমিক ভবনের কাজ নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার আগেই শেষ হবে। ভবনগুলোর আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। এখন শুধু আসবাব ক্রয় করলেই নতুন চারটিসহ সব ভবনে কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। এরই মধ্যে তিনটি হলের কাজও শেষ হবে। সুবিধাবঞ্চিত জনপদে গড়ে ওঠা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো কাজ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্নেই ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার নামে একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছে। এখন সরকারি সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামের সঙ্গে উপস্থাপন করার সম্ভাবনাকে ধারণ করে আছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ করে প্রতিষ্ঠানটিকে সুনামের সঙ্গে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। গবেষণার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর আরেকটি সংস্করণ হয়ে উঠবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। পনেরোটি বিভাগের জন্যই বর্তমানে কয়েক কোটি টাকার পুস্তক ক্রয় করা প্রয়োজন। নতুন বিভাগ আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হলে তার জন্য আরও পুস্তক ক্রয় করার প্রয়োজন হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে বিভাগগুলো এখনও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি। বিভাগীয় সেমিনারগুলোর জন্যও প্রচুর পুস্তক ক্রয় করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানাগার শুরুর লগ্নে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় করতে হবে। এ ছাড়াও অনেক সরঞ্জাম ক্রয় করতে হবে। নির্মীয়মাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান বিকশিত হবে কীরূপে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রশাসনের সমন্বয়ে যে শ্রম-মেধা ব্যয় করে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তৈরি হয়েছে, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকলে এ মেধা-শ্রম সবকিছুই পণ্ড হয়ে উঠবে। শিশু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় সরকার নির্বাহ না করলে বিশ্ববিদ্যালয় অপুষ্টিতে ভুগতে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি যাতে করে প্রতিবন্ধী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বনসাই হয়ে না ওঠে সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রচুর বরাদ্দ থাকা জরুরি।
অতি অল্প সময়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো গড়ার কাজ অনেক এগিয়েছে। এই কাজ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। বর্তমানে যে পরিমাণ অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আরও অনেক বিষয়ে সম্মান কোর্স চালু করা সম্ভব। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে ওঠা এ ভবনগুলো কোনো অবস্থায় ফেলে রাখা উচিত হবে না। দেশে যখন উচ্চশিক্ষার সুযোগ এত কম সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ যতগুলো খোলা যায় ততই বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাসের তুলনায় এত কম পরিমাণে উচ্চশিক্ষার সরকারি ব্যবস্থা, যা আমাদের উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে খুব সামান্যই ভূমিকা রাখতে সক্ষম। চলতি বছরে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় পৌনে ছয় লাখ শিক্ষার্থী। গত বছরে ভর্তি হতে পারেনি এ রকম রয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। শুধু এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চলি্লশ হাজার। বাংলাদেশে সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বুয়েট মিলে যে আসন আছে তা চলি্লশ হাজারের কিছু বেশি। সাধারণ হিসাব করলে শুধু জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর জন্যই এ আসনগুলো প্রয়োজন। এরূপ অবস্থায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে অধিক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে, সেগুলোতে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সিংহভাগ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষা দিয়ে থাকে। এমন অবস্থায় যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা যায় সেটা ভালো। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পনেরোটি বিষয়ে সম্মান কোর্স চলছে। এখানে যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তাতে করে আরও পনেরোটি বিভাগে সম্মান কোর্স চালু করা সম্ভব। একটি বছরও নষ্ট না করে পনেরোটি বিষয়েই সম্মান কোর্স চালু করা প্রয়োজন। তা না হলে নতুন ভবনগুলোর অনেকগুলো কক্ষ অব্যবহৃত পড়ে থাকবে। যুগোপযোগী বিষয়ের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিভাগগুলো চালু করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পাচ্ছে এমন বিষয়ের দিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। আমাদের জনসমস্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার কথা নানাভাবে আমরা বলে আসছি। প্রায়োগিক দিক বিবেচনা করে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে তাই কর্মমুখী বিষয়ে সম্মান কোর্স চালু করা যেতে পারে। গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নতুন নতুন বিভাগ খোলা যেতে পারে। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ব্যবস্থাপনায় যে শিক্ষায়তন রয়েছে তাতে করেও সিংহভাগ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। সে কারণে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুনভাবে গড়ে উঠছে সেগুলোতে অল্প সময়ে অনেক বিভাগ চালু করে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.