গরিবের ঘরের আমির

অভাবের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বন্ধ হয়ে থাকেনি তাঁর স্বপ্ন দেখা। জাতীয় অ্যাথলেটিকসের দশ হাজার মিটারে সোনাজয়ী আমির আলীকে নিয়ে লিখেছেন বদিউজ্জামান বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট বলে একটু বেশিই আদর পেয়েছেন। তবে আদরে আদরে বখে যাননি অ্যাথলেট আমির আলী।


আর্থিক অসচ্ছলতায় পড়াশোনার গতি থমকে গেছে। কিন্তু থমকে থাকেনি বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন বড় অ্যাথলেট হবেন। এবারের জাতীয় অ্যাথলেটিকস আমিরের স্বপ্নে মাখিয়েছে আবির। পাঁচ হাজার মিটারে সবার আগে দৌড় শেষ করেও সোনা জয়ের গৌরব তিনি করতে পারেননি। একজন অজানা-অচেনা প্রতিযোগীকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরাতে রাজি ছিলেন না অ্যাথলেটিকসের বিচারকেরা! জয়ী হয়েও তাই হলেন বঞ্চিত। কিন্তু এই বঞ্চনার আগুনই তাঁকে তাতিয়ে দিল দশ হাজার মিটারে। তাতে জিতে প্রমাণ করলেন সামর্থ্য। পরে অবশ্য পাঁচ হাজার মিটারের সোনাও পেয়েছেন ফিরে। দূরপাল্লার দৌড়ের জোড়া সোনা খুলনার এই তরুণকে দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। এখন ভাঙতে চাইছেন নিজেরই সীমানা।
মাঝে মাঝেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করতেন আমির। মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার পর বাবা সমিরউদ্দিন আর পড়াতে পারছিলেন না, মাদ্রাসার পাঠটা তাই চুকিয়েই দিতে হলো। বৃদ্ধ বাবা সংসারের ঘানিটাও আর টানতে পারছিলেন না। নিজেদের ছোট্ট একটা মাছের ঘের, কয়েক বিঘা ধানি জমি আর সবজির খেত করেও সংসার চলছিল না। বাধ্য হয়ে অন্যের জমিতে কাজ করতে শুরু করেন আমির। কাজের ফাঁকে চালিয়ে যান অনুশীলন। একদিকে কৃষিকাজ, অন্যদিকে অনুশীলন—বড় কষ্টে কাটে তাঁর জীবন।
এভাবে নিয়মিত অনুশীলন করেই ঢাকায় এলেন ৩৭তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে। দূরপাল্লার দৌড়ে ৫০০০ মিটারে সবার আগে দৌড়েও শেষ পর্যন্ত সোনার পদক গলায় তুলতে পারলেন না। এক পাক কম ঘুরেছেন, এই অভিযোগে আমিরকে বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর জামরুলকে চ্যাম্পিয়ন করা হয়। প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে আমিরের ক্লাব চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা। পরদিন আবারও ট্র্যাকে নামেন। জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম সোনা জেতেন ১০ হাজার মিটারে। এই সোনাই ‘সোনায় সোহাগা’ হয়ে এল আমিরের জীবনে। গ্রাম থেকে উঠে আসা অখ্যাত তরুণ রাতারাতি হয়ে গেলেন রূপকথার নায়ক। প্রতিযোগিতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্ট বাদ দিয়ে সব আলো গিয়ে পড়ল ১০ হাজার মিটারে সোনাজয়ী আমিরের ওপর।
ছেলেবেলা পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারা দিন পাড়াময় ঘুরে বেড়াতেন আমির। সন্ধ্যা হলেই চোখের পাতা টেনে ধরত ঘুমে। কিন্তু শুরু হতো বাবার বকুনি, ‘সারা দিন শুধু খেলা আর খেলা। পড়াশোনা করা লাগবে না। খেলাধুলাই করে বেড়াও তুমি।’
পড়াশোনায় যতি টানার পর বিজেএমসিতে যোগ দেন আমির। বাড়ির পাশের স্কুলমাঠে প্রতিদিন চালান কঠোর অনুশীলন। একদিনের ঘটনা। আমির তখন অনুশীলন শেষে হাঁটুতে হাত দিয়ে দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে ফুলতলা বাজারে যাচ্ছিলেন বাবা। আমিরের কষ্ট দেখে মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে যান। এরপর আমিরকে ডেকে বলেন, ‘তোর আর অত কষ্ট করে কাজ নেই। আমার যে জমিজমা আছে সেটা দেখাশোনা কর। দরকার হলে একটা দোকান করে দিচ্ছি। দোকানে বসে থাক।’ কিন্তু অ্যাথলেটিকসের নেশা ঢুকে গিয়েছিল রক্তে। মুদি দোকানি হওয়ার ইচ্ছাটা বাদ দিয়ে বললেন, ‘বাবা, এই কষ্ট আমার মোটেও গায়ে লাগে না। এই কষ্টের মধ্যেও অন্য রকম আনন্দ আছে। চ্যাম্পিয়ন হলে কোনো কষ্টকেই কষ্ট মনে হয় না।’
চ্যাম্পিয়ন আমির বাড়িতে ফেরার পর প্রতিবেশীদের মধ্যে শুরু হয়েছে সে কি উন্মাদনা! পাড়ার চায়ের দোকানে, পাঠাগারে, যুব উন্নয়ন সমিতিতে—যেখানেই যাচ্ছেন, সবাই সমীহের চোখে তাকাচ্ছে।
মানুষের ভালোবাসা পেয়ে ধন্য আমির উপেক্ষা ও বঞ্চনার ওই অধ্যায় ভুলে যেতে চান একেবারেই। স্থানীয় প্রশাসন ও বন্ধুরা আমিরকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।
তবে আবেগে ভেসে যেতে চান না আমির, জানেন তাঁকে ছুটতে হবে, দৌড়াতে হবে আরও। খুলনার ফুলতলার এই তরুণ মনে মনে সাজাচ্ছেন পরিকল্পনা, ‘দূরপাল্লার দৌড়ে আমাদের দেশে সেভাবে কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো ফল করতে পারছে না। ফেডারেশন আমাকে ক্যাম্পে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সুযোগ পেলে দেখিয়ে দিতে চাই, আমারও দেশকে দেওয়ার কিছু আছে।’ এক প্রকার জোর করেই ১০ হাজার মিটারে যাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই আমিরের লক্ষ্য এসএ গেমসে সোনা জয়।

No comments

Powered by Blogger.