ইতি-নেতি-'দিন' এখন সত্যি সত্যিই বদলাতে হবে by মাসুদা ভাট্টি

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে তখন এক বহুকালদর্শী সাধারণ মানুষকে বলতে শুনেছিলাম, 'দিনটা যদি সত্যিই বদল হইত তাইলে ভালো হইত। কিন্তু দিন কি বদলাইব?' আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের নাম ছিল দিনবদলের সনদ।
নির্বাচনের আগে প্রচারের ডামাডোলে বিষয়টি খুব একটা বোঝা যায়নি; কিন্তু ক্ষমতায় আসার প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষভাবে দিনবদলের যে চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন, তাতে আশাবাদী না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। বিশেষ করে বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র চরিত্রের যে নতুন রূপ আমরা দেখছি তাতে দিনবদল যে সত্যিই জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দিন সত্যিই বদলাচ্ছে কি?
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে যে ত্যাগ, সর্বোপরি যে 'ভিশন' কাজ করেছে একাত্তরের পরে যারা জন্মেছে তাদের শত চেষ্টা করেও তা পুরোপুরি বোঝানো যাবে না। প্রতিটি সময়ের একটি দাবি আছে, আছে সময়ের ভাষাও, একাত্তর বা তার পূর্ববর্তী সময়ের যে ভাষা একাত্তর-পরবর্তী সময়ের ভাষার সঙ্গে তার মিল খুব সামান্যই। আর পঁচাত্তরের পরে তো আমাদের জাতীয় চরিত্রের ভাষা সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে এক ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম নেয়, যার মূলে থেকে যায় ধর্মান্ধতা, কালো টাকা, অস্ত্র, অস্থিরতা, সহিংসতা ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দ। এসবের উল্লম্ফনে একাত্তর-পূর্ববর্তী মূল স্রোতটি ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হয়ে ওঠে। এর ভেতর বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে বাঁধ মানানোর কিংবা প্রকৃত সত্য জানানোর প্রচেষ্টা হয়নি, এমনকি তাদের সামনে আদর্শ রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা পারিবারিক চরিত্রও ছিল না, যাকে উদাহরণ হিসেবে দেখে সে শিখতে পারে। সুতরাং বর্তমান সময়ের অস্থিরতার সঙ্গে যারা জড়িত ও এই অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। বরং এই অস্থিরতার কালকে বাস্তব জেনেই আমাদের এগোতে হবে। আর সেটুকু মেনে নিয়ে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, মানুষ এখন যথেষ্ট হিসাবি, খানিকটা স্বার্থপরও, নিজের ভাগে কম পড়লে অপরেরটা কেড়ে নিতে দ্বিধা করে না, এখন আরেকটি একাত্তর এলে ক'জন সত্যিকারের একাত্তরের মতো জীবন, অর্থ, ভালোবাসা বাজি রেখে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ অমূলক হবে না। এই সন্দেহ নেতিবাচক কিংবা বর্তমান প্রজন্মকে হেয় করার জন্য বরং বাস্তবতা বিশ্লেষণ থেকেই এ উপলব্ধি। কোনো মানুষকেই নাকি ১৮ বছরের পরে আর বদলানো যায় না, যদি না তিনি নিজে বদলাতে চান। মনোবিজ্ঞানীদের এই তত্ত্ব আন্তরিক বিশ্বাস রেখেই আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদকে ব্যাখ্যা করেছি।
বাংলাদেশ একটি অস্থির অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে বিগত জোট আমলে রাষ্ট্রের যে নৈতিক স্খলন ঘটে তা তত্ত্বাবধায়ক আমলে এসে সীমা অতিক্রম করে। আর কিছুকাল এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে দেশ নিশ্চিত এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় দিনবদলের কথা বলাটা ছিল আওয়ামী লীগের একটি সময়োপযোগী বারতা, যা জনগণ বিশ্বাস করতে চেয়েছে। কিন্তু চুন খেয়ে যেহেতু মানুষের মুখ পুড়েছে তাই দিনবদলের সনদের মতো পুষ্টিকর দই দেখেও তারা ভয় পেয়েছে, তবুও আস্থার জায়গা একটি প্রয়োজন, নইলে যে অথৈ খাদে পড়তে হবে, সে ভাবনা থেকেই মানুষ দিনবদলের সনদবাহী নৌকায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। নূহ-এর নৌকার মতো ২০০৮ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের নৌকা ছিল বাঙালির শেষ আশ্রয়। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের আস্থার পারদ কেবলই বেড়েছে আর সরকারের সামান্য ভুলচুকেও মানুষ নিদারুণ আশা ভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে যে কথাটি মূল আলোচ্য বিষয় তা হলো দিনবদলের অন্তর্নিহিত ধারণাটি কেন এখন পর্যন্ত মানুষের কাছে পেঁৗছে দেওয়া যায়নি? দিনবদল মানে কি রাতারাতি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা? উত্তর হচ্ছে, না। দিনবদল মানে কি তবে রাতারাতি দেশের মানুষের মানসিকতা বদলে ফেলা? উত্তর, না। দিনবদল মানে কি দুই দিনের মধ্যেই দেশকে সোনায় মুড়ে দেওয়া? স্পষ্ট উত্তর, না। তাহলে দিনবদল মানে কী? আমার মনে হয়, সরকার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রচারমাধ্যমের এখানেই ব্যর্থতা। এখানেই দিনবদলের বিষয়টি ক্রমশ জলো হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা নানা সমস্যাপূর্ণ, জীবন এখানে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও অপশক্তির যূপকাষ্ঠে নিয়মিত বলি হয়; রাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে রয়ে গেছে নানা অসংগতি, নাগরিকের মাঝে সংবিধানের দ্বারা সিদ্ধ হয়েই বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়; যাদের দিয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা তারাই ভক্ষক হয়ে নাগরিকের সম্পদ, এমনকি প্রাণটাও আত্মসাৎ করতে তৎপর; প্রজাতন্ত্রের ও জনগণের সেবা হিসেবে যারা জনগণেরই অর্থে প্রতিপালিত তাদের একজনের স্বার্থে আঘাত লাগলে সর্বত্রই গেল গেল রব ওঠে। ভেবে দেখুন একজন পুলিশ, র‌্যাব কিংবা সেনাবাহিনীর সদস্য যদি কোথাও আক্রান্ত হয় তাহলে তার পেছনে গোটা বিভাগ, এমনকি সরকারও দাঁড়িয়ে যায় নির্দ্বিধায়। একই কথা প্রযোজ্য সরকারী কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও। যখনই তাদের স্বার্থে কোথাও হানি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয় তখনই তারা বূ্যহ বেঁধে সরকারকে ফেলে দেওয়ার তোড়জোড় করে। যতই আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলি না কেন, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরও প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঝুঁকতেই হয়। কারণ অতীতে নির্বাচনী ফলাফল বদলে যাওয়ার যে তুঘলকি অভিজ্ঞতা হয়েছে তা তো বন্ধ করতে হবে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আসলে মানুষের অনুকূলে নয় এবং এ থেকে ধীরে ধীরে জনগণকে বের করে আনাই যে দিনবদলের লক্ষ্য_এ কথা বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে মানুষ জানলেও যতই দিন যাচ্ছে ক্রমশ যেন সরকারের কিংবা দলের কর্তাব্যক্তিরা যেমন তা বিস্মৃত হচ্ছেন তেমনি জনগণও ভুলে যাচ্ছে কেন, কিসের জন্য, কোন আশায় তারা বর্তমান সরকারকে ভোট দিয়েছিল, দিয়েছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। স্বীকার্য যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই কিছু মৌলিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছে, যা দিনবদলের সনদের মূল বার্তা বলেই আমরা বিশ্বাস করি। দেশে ঘটে যাওয়া সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিংবা হত্যাচেষ্টার বিচার করা, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা, পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন, নাগরিকের আরো ক্ষমতায়ন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ করা ইত্যাদি অবশ্যই দিনবদলের সনদের মৌলিক প্রতিশ্রুতি এবং সেগুলো বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছে তাতে প্রশংসা করতেই হবে। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায় এবং সে কথাগুলোই আগামী সপ্তাহে বলার ইচ্ছা রাখি।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com

No comments

Powered by Blogger.