রম্যরচনা-স্বাস্থ্য সম্পদ by সাইফুল আলম

গত দু'দিন ধরে কিসমিস আলীর মেজাজটা বড় খারাপ। সাবেক কলেজ শিক্ষক এ কিসমিস আমার অনেক পুরনো বন্ধু। বাবার আদর করে রাখা এ নামটা মাঝে মধ্যে একটা কুঁচকানো কিশমিশের মতোই যেন ওর চেহারায় ভেসে ওঠে।


'ব্যাপারটা কী দোস্ত?' আমি জিজ্ঞাসা করতেই ওর ভ্রু দুটির মাঝখানটা যে পৌনে দু'মিলিমিটার গভীর হয়ে আরও কুঁচকে এলো। কণ্ঠে বিরক্তি মেখে বলল, 'আর বল না, আমার ঘরের ওই গাধাটা দু'দিন ধরে পেটের পীড়া বাধিয়ে বসেছে।' স্ত্রীহারা নিঃসন্তান কিসমিসের ঘরে একমাত্র গৃহপরিচালক কালাম ছাড়া আর কোনো প্রাণী যে নেই তা আমার অজানা নয়। বললাম 'কে? তোমার ওই মোর পুরাতন ভৃত্য কালামের কথা বলছ নাকি?'
_'তবে আর কী? ও ছাড়া আমার আর আছেইবা কে।'
_'তা মানুষের তো অসুখ-বিসুখ হতেই পারে। এতে তো কারোর কোনো হাত নেই।'
_'দেখো, ওসব পুরনো বাণী আর শুনিও না। এমন কিছু অসুস্থতা আছে যা রোগীর নিজের দোষেই হয়ে থাকে।' আমি কিসমিসের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধালাম, 'তা এমনটা হলো কীভাবে?'
সন্ধ্যার ছোঁয়া লাগা এক পড়ন্ত বিকেলে আমরা দু'বন্ধু মিলে ধানমণ্ডির লেকের ধারে হাঁটছিলাম। কিসমিস আমার প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, 'গাধাটা গত পরশু সন্ধ্যায় রাস্তার পাশের একটা মোবাইল হোটেল থেকে এক প্লেট চটপটি গোগ্রাসে গিলে এসেছে। তারপর গভীর রাত থেকে শুরু হয়েছে বেহাল অবস্থা। বাথরুমের সিজেনাল টিকিট কেটে শুধু যাচ্ছে আর আসছে।'
_'তা এখন কেমন?' আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলাম।
_'চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়ার পর কিছুটা ভালো।'
_'আহা! বেচারার শখ হয়েছে খেয়েছে। কে আর জানত যে, এ অবস্থা হবে।' কিসমিস আমার কথায় যেন তড়িতাহত হয়ে ধপাস করে সামনের বেঞ্চটায় বসে পড়ে চুপ করে রইল। অগত্যা আমিও ওর পাশে বসলাম। কিঞ্চিৎ পর নিচু স্বরে শুধালাম, দোস্ত, রাগ করলে নাকি?' কিসমিস আমার চোখে দৃষ্টি ফেলে বলল, 'না, তবে কোনো সমস্যার কথা উঠলে তোমার ওই কম্প্রমাইজিং স্বভাবটা আমাকে মাঝে মধ্যে বড্ড খোঁচা দেয়।' আমি ওর কথায় লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলাম। কিসমিস হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমি ওর সঙ্গ নিলাম। কিঞ্চিৎ হাঁটার পর ও বলল, 'দোস্ত, এ মহানগরীর একটা দৃশ্য আমাকে বড্ড ভাবিয়ে রাখে।'
_'কী দৃশ্য? বলই না।' আমি আগ্রহ সঞ্চয় করে জানতে চাইলাম।
_রাস্তার ধারে, খোলা ড্রেনের ধারে, ফুটপাত দখল করে নোংরা পরিবেশে খাবার দোকান সাজিয়ে দিনের পর দিন নির্বিঘ্নে ব্যবসা।' কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে ভর ভর করে বলে ও দম নিল। আমি কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে নিম্নমুখী হয়ে হাঁটতে থাকলাম। আমার নীরবতাকে জাগিয়ে তুলতে কিছুক্ষণ পর ও বলল, 'কী হলো, কিছু বলছ না যে?'
_'দৃশ্যটা আমরা সবাই লক্ষ্য করছি, কিন্তু_'
_'কিন্তু গায়ে মাখছি না_ তাই তো?'
_'ঠিক তাই'_ আমি বললাম।
_'কিন্তু দোস্ত, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া কি আমাদের উচিত নয়?' আমার দিকে প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিল কিসমিস। আমার এ বন্ধুটির কোনো প্রশ্নের উত্তর যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে না দেওয়া হয় তবে যে আরও প্রশ্নের তীর ছুটে আসবে সেটা আমার জ্ঞাত আছে। তাই অনেক যত্ন মাখিয়ে নরম কণ্ঠে বললাম, 'তা ঠিক বলেছ দোস্ত। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।' আমার উত্তরে কিসমিসের কোঠরাগত ডুবসাঁতার দেওয়া নয়নতারা দুটি যেন ক্ষণিক ভেসে উঠল। ঠোঁটের কোণে এক ফালি কাস্তে মার্কা হাসি প্রসব করে বলল, 'ঠিক, ঠিক বলেছ দোস্ত।' ওর সমর্থন আমার বুকে মৃদু গর্ব ফেলে দিল। শুধালাম, 'তা এ বিষয়ে তোমার কোনো পরামর্শ আছে নাকি?'
_'আছে। তবে পরামর্শ প্রদানের আগে একটা প্রশ্ন আমাকে সর্বদাই তাগাদা দেয়।'
_'কী? কী সেটা?'
_'আচ্ছা, স্বাস্থ্য সম্পদ রক্ষা করাটা কি শুধু ধনী আর উচ্চশ্রেণীর জন্যই প্রযোজ্য?' কিসমিসের প্রশ্নে যেন দৃঢ়তা।
_'তোমার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না দোস্ত_' আমি বিস্ময়কে সঙ্গী করে জানতে চাইলাম। কিসমিস বলতে লাগল, 'প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি মহানগরের অভিজাত এলাকার বড় বড় সব অভিজাত হোটেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত হানা দিচ্ছেন।'
_'হ্যাঁ_ তাই তো।'
_'কোনো হোটেলের কিচেনে তেলাপোকার ছানা ধরা পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায় করে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, অথচ'_ এ পর্যন্ত বলে কিসমিস থামল।
_'অথচ কী?' আমি জানতে চাইলাম।
_'অথচ দরিদ্র নিম্নশ্রেণীর মানবকুল যে খোলা ড্রেনের ধারের কথাকথিত হোটেল থেকে মশা-মাছি ওড়া আর রোগ-জীবাণু মাখা খাবারগুলো নিত্যদিন পাকস্থলীতে চালান দিচ্ছে, সেটা দেখার কেউ নেই।'
আমি আমার বন্ধুটির দিকে সমর্থনের চাহনি মেলে বললাম, 'তুমি ঠিকই বলেছ দোস্ত।' আমার কথাটা ইথারে ভর করার আগেই ও বলল, 'আমাদের পাবলিক হেলথ, পরিবেশ অধিদফতর, সিটি করপোরেশন_ এসবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাকে ভেজাল শর্ষের তেল ঢেলে নাক ডাকাচ্ছেন, যেন কুম্ভকর্ণও হার মানছে।' আমি কিসমিসের আক্ষেপে একটা নরম সহানুভূতির গন্ধ পেলাম। বললাম, 'দোস্ত শুধু ঢাকা মহানগরীতে কেন, সারাদেশেই এ দৃশ্য বিদ্যমান।'
_'তা ঠিক বলেছ। অথচ উন্নত দেশের হোটেলের কিচেন থাকে পেছনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। আমাদের দেশের হোটেলের কিচেনগুলো ফুটপাতে অবস্থান নিয়ে ধোঁয়া আর সুগন্ধ ছড়িয়ে আমাদের মতো নির্বোধদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এতে রাস্তাঘাটও নোংরা হচ্ছে।' আমি মৃদু হাসি টেনে বললাম,
_'আর তোমার কালাম, ওই হাতছানিতে সাড়া দিয়ে বেহাল অবস্থা বাধিয়ে বসেছে।'
_'হ্যাঁ, ঠিক তাই।' আমি এবার কিছুটা সংকোচ আমদানি করে ধীর কণ্ঠে বললাম।
_'দোস্ত আর একটা অস্বাস্থ্যকর খবর আমার কানে এসেছে, জানি না কতখানি সত্য।'
_'কী সেটা। বলেই ফেল না।'
_নগরীর কোনো কোনো স্থানের রাস্তার ধারে নাকি বিয়েবাড়ির উচ্ছিষ্ট বিরিয়ানি গাড়ি ভর্তি করে দেদার বিক্রি হচ্ছে। আর একশ্রেণীর মানবপ্রাণী তা চেটেপুটে খাচ্ছে।'
_'খাচ্ছে তো খাচ্ছে_ খাচ্ছে তো খাচ্ছেই তাই না' কিসমিসের কণ্ঠে যেন কৌতুক।
_'হা তাই।'
_তবে সঠিক অনুসন্ধান করলে বিষয়টা কতখানি সত্য তা বেরিয়ে আসবে বৈকি।'
_'কিন্তু এ পরিস্থিতির সমাধানইবা কী? গরিব মানুষকেও তো সস্তায় খেয়ে বাঁচতে হবে। তা তোমার মাথায় কোনো পরামর্শ খেলছে নাকি?' আমার জিজ্ঞাসা শুনে কিসমিস তার হাঁটার গতিটাকে এক গিয়ার নামিয়ে বলল, 'ফুটপাতের সমস্ত খাবারের আয়োজনকে উচ্ছেদ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানে স্থানে টংঘর করে খাবার ব্যবস্থাকে ছাউনির নিচে আনতে হবে। এতে খানিকটা হলেও বিরাট অঙ্কের মানুষের স্বাস্থ্য সম্পদ রক্ষা পাবে। আর ওই ভ্রাম্য আদালতকে সব ক্ষেত্রেই তৎপর হতে হবে।'
মনে মনে ভাবলাম কিসমিসের তাৎক্ষণিক পরামর্শটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, 'দোস্ত অনেকক্ষণ তো হাঁটলাম। সন্ধ্যাও গড়িয়ে গেছে। চল না আমার বাসায়, রাতের ডিনারটা সেরেই যাবে।'
_'আজ নয় দোস্ত। কালামটার জন্য মনটা খচখচ করছে। বাড়ি ফিরতে হবে।' আমি ওকে আর জোর না করে পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে বললাম, 'দোস্ত ফুটপাতের খাবারকে ঘিরে শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমাদের সটকে পড়লে হবে না। জনগণকে সচেতন হতে হবে।
_'নিশ্চয়, ঠিক বলেছ দোস্ত। তা আজকাল তোমার বেশ বুদ্ধি খুলছে। যুক্ত মাখিয়ে খাসা বলেছ। তবে আইনের কঠোর প্রয়োগটাও জরুরি।' আমি ওর কথায় আরও আধা কেজি ওজনের উৎসাহ নিয়ে বললাম, 'সেটাও ঠিক। লক্ষ্য করলে দেখবে, আমাদের দেশের এ মানুষই কোনো উন্নত দেশে গেলে আইনের চাপকলে একেবারে সোজা হয়ে যায়।'
আমার এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে কিসমিস বলল, 'দোস্ত আজ আমি আসি, ফের দেখা হবে।' বলেই ও একটু দ্রুতলয়ে সামনের দিকে পা চালাল। আমি সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গৃহমুখী হলাম।

ডা. সাইফুল আলম : ডেন্টাল সার্জন
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
 

No comments

Powered by Blogger.