সুশাসন-এ যেন আইন ভঙ্গেরই উৎসব by বদিউল আলম মজুমদার

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন ভাঙার অভিযোগ বহু দিনের। তবে সাম্প্রতিককালে তা যেন বেসামাল পর্যায়ে পেঁৗছেছে। লিমন, কাদের, মিলনের ঘটনা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। লিমনদের বিরুদ্ধে পুরো রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোর সংশ্লিষ্টদের অপ্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।


বরং এর মাধ্যমে তারাই নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। জনগণ আর তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ প্রায় সব নাগরিকেরই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে এক বা একাধিক খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে


প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক জন লকির একটি বিখ্যাত উক্তি_ ্তুডযবৎবাবৎ ষধ িবহফং, ঞুৎধহহু নবমরহং.্থ আইনের প্রয়োগ যেখানে শেষ, স্বৈরতন্ত্রের শুরু সেখানে। অন্যভাবে বলতে গেলে, আইনের শাসন যেখানে অনুপস্থিত, জঙ্গলের শাসন সেখানে বিরাজমান। অর্থাৎ সেখানে জোর যার মুল্লুক তার। নিয়ম-পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় সেখানে। ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা ব্যক্তিরাই লাল-সবুজ বাতি ব্যবহার করে সেখানে আইনের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে সেখানে আইনের শাসনের পরিবর্তে 'আইনের দ্বারা', ব্যক্তি-নিয়ন্ত্রিত আইনের দ্বারা সবকিছু পরিচালিত হয়। আর এ অবস্থা সুশাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কারণ সুশাসনের প্রথম পদক্ষেপই হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।
আইনের শাসন তথা সুশাসনের অনুপস্থিতির মাশুল সাধারণত দরিদ্রদেরই দিতে হয়। দরিদ্ররা সমাজে প্রতিপত্তিশালী নয়। তাদের সঙ্গে শাসকশ্রেণীর দহরম-মহরম থাকে না। এমনকি সে ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগও অনুপস্থিত। বরং শাসকশ্রেণীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দাতা-গ্রহীতার। তারা হালুয়া-রুটির যে উচ্ছিষ্ট অংশ (যদিওবা) পায়, তা ক্ষমতাধরদের করুণা বা লেনদেনের বিনিময়েই পায়, তাদের আইনানুগ ন্যায্য প্রাপ্য হিসেবে নয়। আর আইনের শাসনের অভাবে, কোনোরূপ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই, শাসকশ্রেণী তাদের নিজেদের স্বার্থ এবং কল্যাণেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গত দুই দশক থেকে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দুই বছর ছাড়া, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করে আসছেন। তারা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কারণ আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, দেশে আইন ভঙ্গের একটি অশুভ উৎসবই যেন চলছে। আমাদের ক্ষমতাধররা যেন আইন ভঙ্গের এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কয়েকটি উদাহরণ থেকেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব।
গত ৭ আগস্ট ২০১১ তারিখের প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল 'নৌমন্ত্রীর চাপে নমনীয় যোগাযোগমন্ত্রী'। আনোয়ার হোসেনের লেখা প্রতিবেদনটির মূলকথা হলো_ আমাদের মাননীয় নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সংগঠন 'বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন,' যার তিনি কার্যকরী সভাপতি, কোনো ধরনের দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা ছাড়াই ২৪ হাজার ৩৮০টি লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সম্প্রতি বিআরটিএতে আবেদন করেছে। আবেদনপত্রে মাননীয় মন্ত্রী প্রতিস্বাক্ষর করেছেন। প্রথম আলোর তথ্যানুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নৌমন্ত্রীর সংগঠনের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরীক্ষা ও প্রক্রিয়া না মেনেই ১০ হাজার চালককে পেশাদার লাইসেন্স দিয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআরটিএ। এবারও মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর ভাষায়, 'নূ্যনতম পরীক্ষা নিয়ে কীভাবে লাইসেন্স দেওয়া যায়, সে বিবেচনা করছি।'
১৯৯০ সাল থেকেই পরীক্ষা ছাড়া পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবশ্য এ অনিয়ম বন্ধ ছিল, যা আবার বর্তমান সরকারের আমলে পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। বিআরটিএ এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ পেশাদার লাইসেন্স দিয়েছে, যার প্রায় চার লাখই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের আবেদনের প্রেক্ষিতে যথাযথ পরীক্ষা ও প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে নির্ধারিত পরীক্ষা ছাড়া ৬টি শ্রমিক ইউনিয়নের তালিকা ধরে ১০ হাজার ৮২টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। আইনকানুন উপেক্ষা করেই এবং অর্থের বিনিময়েই এগুলো দেওয়া হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার এমন অনুরোধ শ্রমিক সংগঠনগুলোর জন্য এক ধরনের বাণিজ্য, যা 'লাইসেন্স বাণিজ্য' বলে আখ্যায়িত।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, লাইসেন্স পেতে সংশ্লিষ্টদের প্রথমেই যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে 'লার্নার' বা শিক্ষানবিশ লাইসেন্স নিতে হয়। পরবর্তীকালে তিন মাস পর লিখিত, মৌখিক ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণের মাধ্যমে ছোট বা হালকা যানবাহন (যেমন কার, অটোরিকশা, জিপ) চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায়। এর অন্তত তিন বছর পর পুনরায় পরীক্ষা প্রদান করে মাঝারি ধরনের যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নিতে হয়। এই লাইসেন্সে মিনিবাস, পিকআপ ভ্যান, মিনি ট্রাকসহ ছোট যানবাহন চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। মাঝারি যানবাহন পাঁচ বছর চালানোর পর ভারী যানবাহনের লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে হয়। অর্থাৎ লিখিত, মৌখিক ও গাড়ি চালানোর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ভিত্তিতেই লাইসেন্স পেতে হয়_ এটিই আইন। তাই বিনা পরীক্ষায় লাইসেন্স দেওয়ার অনুরোধ করা ও তা দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। আর এ বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত আমাদের মাননীয় মন্ত্রী!
পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া মানে দক্ষতা যাচাই ছাড়াই গাড়ি চালাতে, এমনকি ভারী যানবাহন চালাতে অনুমতি দেওয়া। বিআরটিএ পরিচালিত এক তদন্ত থেকে দেখা যায়, শ্রমিক সংগঠনগুলোর লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ করার তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের পরীক্ষা তো দূরে থাক, তারা কোনো রকম ফরমও পূরণ করেনি। অর্থাৎ পরীক্ষা ছাড়াই যাকে-তাকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে পেশাদার লাইসেন্স এবং গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন অরাজকতামূলক অবস্থা বিরাজ করে কি-না, তা আমাদের জানা নেই।
বলাবাহুল্য যে, এ ধরনের বেআইনি কাজের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রত্যেক দিনের সংবাদ শিরোনাম থেকে আমরা জানতে পারি, বহু ব্যক্তির হতাহতের খবর। উদাহরণস্বরূপ, থানায় মামলা হয়েছে_ এমন সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছে। এগুলো হত্যা, যার অন্যতম কারণ চালকের অদক্ষতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে চালকের ভুল জড়িত। এসব অহেতুক মৃত্যুর দায় কি শ্রমিক সংগঠনগুলো ও বিআরটিএ এড়াতে পারে? আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে মাননীয় নৌমন্ত্রী কি এর জন্য একটুও বিবেকের দংশন অনুভব করেন না!
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে মাননীয় নৌমন্ত্রী উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন সভায় উপস্থিত থেকে যেসব প্রস্তাব করেন, তা সব সময় জনস্বার্থের অনুকূলে, এমনকি নৈতিকতার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন, গত ১৬ মে পরিবহন খাতের ভাড়া নির্ধারণের বৈঠকে উপস্থিত থেকে তিনি মালিকদের পক্ষ নেন। এরপর ২৭ জুলাই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক বৈঠকে পরিবহন খাতের চাঁদা সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন : মন্ত্রী হিসেবে 'ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ' করার শপথ নিয়ে তিনি কি নৈতিকভাবে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতির ভূমিকা পালন করতে পারেন? তিনি কি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে পারেন? 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট' বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি কি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়? দুর্ভাগ্যবশত আমাদের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের জন্য কোনো আচরণবিধি আইন নেই। মাননীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে এখনও পাস হয়নি।
আইন লঙ্ঘনের আরেকটি নগ্ন দৃষ্টান্তের প্রতি নজর দেওয়া যাক। গত ৫ আগস্ট ২০১১ তারিখের যুগান্তরের একটি শিরোনাম, 'বিধি লঙ্ঘন করে তারা সংসদীয় কমিটিতে বহাল তবিয়তে।' শিরোনামটির পেছনের সংবাদটি হলো, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি লঙ্ঘন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি উপেক্ষা করে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে স্থান পাওয়া ১২ জন মাননীয় সংসদ সদস্য এখনও সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যপদ ধরে আছেন। আমাদের জানামতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত বছর এসব ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরকারি দলের মাননীয় চিফ হুইপও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হবে।
জাতীয় সংসদ কার্যপ্রণালি বিধির ১৮৮ (২) ধারা অনুযায়ী, 'এমন কোন সদস্য (সংসদীয় স্থায়ী) কমিটিতে নিযুক্ত হইবেন না, যাহার ব্যক্তিগত, আর্থিক ও প্রত্যক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হইতে পারে এমন বিষয়ের সহিত সংশ্লিষ্টতা আছে।' এই বিধানের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, 'এই উপ-বিধিতে সদস্যের স্বার্থ বলিতে প্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত বা আর্থিক স্বার্থ বুঝাইবে এবং এমন কোন ব্যক্তি কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হইবেন না, যাঁহার অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি রহিয়াছে এবং যাঁহার অন্তর্ভুক্তি সাধারণভাবে জনস্বার্থের অনুকূলে নয়, অথবা কোন শ্রেণীবিশেষ অথবা উহার অংশের পরিপন্থী, অথবা রাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী যাঁহার অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি রহিয়াছে।' জাতীয় সংসদ কার্যপ্রণালি বিধি সংসদ অনুমোদিত একটি আইন। ফলে এ আইন না মেনে আমাদের ১২ জন সম্মানিত আইন প্রণেতা আইন ভঙ্গকারীতে পরিণত হয়েছেন। তাই আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, তাদের বাদ দিতে হবে কেন, তাদের ব্যাপারে তদন্ত হতে হবে কেন? আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে তারা নিজেরাই তো পদত্যাগ করতে পারেন!
প্রসঙ্গত, আমাদের সংসদ সদস্যদের কারও কারও সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যুগান্তরের প্রতিবেদনেই একজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত হলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। তাই সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ১২ ধারা অনুযায়ী, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত ব্যক্তিরা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য। তাই আমাদের আইন প্রণেতাদের কেউ কেউ সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। এ ব্যাপারে কারও পক্ষ থেকেই কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের একটি অংশ এগুলো ছাড়াও 'দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার-বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্যসহ' আরও বহু বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত। ফলে সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক হেডলাইন অনুযায়ী, 'শতাধিক এমপি সরকারের মাথাব্যথার কারণ' হয়ে দাঁড়িয়েছে (আমাদের সময়, ২৩ জুলাই, ২০১১)।
আইন অমান্য করার আরেকটি বিষয়ে আসা যাক। সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের অন্যতম শর্ত হলো, তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (৮ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখ পর্যন্ত সংশোধিত) গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে একজন ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রয়েছেন, যদিও ছাত্রদলকে বিএনপির অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে অস্বীকার করা হয়। যেমনিভাবে আইন মানার প্রতি 'লিপ সার্ভিস' দেওয়ার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও অস্বীকার করে ছাত্রলীগকে তাদের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে। কিন্তু তানভির সোহেলের তৈরি 'ছাত্রদলে দ্বন্দ্বের নেপথ্যে বিএনপি নেতারা' শিরোনামের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে মাননীয় সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী স্বীকার করেছেন, 'বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে সংগঠনটি দেখভালের দায়িত্ব চেয়ারপারসন আমাকে দিয়েছেন।' ছাত্রদল যদি বিএনপির অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে এর দেখভালের দায়িত্ব কেন দলের একজন সম্পাদকের কাঁধে? এই তো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আইন মানার নমুনা! এসব বেআইনি ও অনৈতিক খেলার দীর্ঘমেয়াদি পরিণাম কি শুভ হবে?
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন ভাঙার অভিযোগ বহু দিনের। তবে সাম্প্রতিককালে তা যেন বেসামাল পর্যায়ে পেঁৗছেছে। লিমন, কাদের, মিলনের ঘটনা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। লিমনদের বিরুদ্ধে পুরো রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোর সংশ্লিষ্টদের অপ্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। বরং এর মাধ্যমে তারাই নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। জনগণ আর তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ প্রায় সব নাগরিকেরই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে এক বা একাধিক খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমার নিজেরও তেমন অভিজ্ঞতা আছে।
এটি সুস্পষ্ট যে, চারদিকে আইন ভঙ্গের এক অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে বিচারের বাণী আজ যেন সারাদেশে নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। আর মানুষ ক্রমাগতভাবে আইন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ফলে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন তাদের নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। আমাদের সময়ের এক সাম্প্রতিক (৮ আগস্ট ২০১১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সাত মাসে গণপিটুনিতে ৮৮ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। এসব মৃত্যুর একটি অংশ নাকি পুলিশের উস্কানিতে ঘটেছে। এ ধরনের ভয়াবহ সংবাদ যে কোনো শান্তিকামী নাগরিককেই শঙ্কিত করতে বাধ্য।

ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
 

No comments

Powered by Blogger.