রঙ্গব্যঙ্গ-মোটা আঙুল by মোস্তফা কামাল

'আঙুল ফুলে গলাগাছ' কথাটি প্রবাদে আছে। কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনেও এ কথাটি প্রচলিত। আমরা যখন দেখি কোনো মানুষ হঠাৎ বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তখন তিরস্কার করে বলি, লোকটা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। চোখের পলকে কোটিপতি! আমাদের সমাজে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এরকম একটি ঘটনার কথা বলি।


রফিউদ্দিন ও আবদুর রহমান দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা ছোটবেলা থেকে একই সঙ্গে বড় হয়েছে। একই সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছে। চাকরির জন্য দুজন অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। কোথাও কোনো চাকরি মেলেনি। তারপর দুই বন্ধু পরামর্শ করে ঠিক করল, তারা রাজনীতি করবে। একজন ক্ষমতাসীন দলে ঢুকবে, আরেকজন বিরোধী দলে। রাজনীতি করার জন্য তো আর ইন্টারভিউ লাগে না! প্রশিক্ষণ কিংবা অর্থলগি্নরও খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না।
রফিউদ্দিন তার বন্ধু আবদুর রহমানকে উদ্দেশ করে বলল, 'আমি কিন্তু সরকারি দল করব। বাবার আদেশ, আমাকে মানতেই হবে।'
কিছুটা কৌতূহলের সঙ্গেই আবদুর রহমান জানতে চাইল, হঠাৎ এই আদেশ!
রফিউদ্দিন বলল, বাবা বললেন, স্রোতের উল্টা দিকে নাকি বেশিদূর যাওয়া যায় না। সে কারণে স্রোতের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে হবে। এবার বুঝতে পারছ?
আবদুর রহমান বলল, 'তা বুঝতে পারছি। তাহলে আমিও সরকারি দলই করি!'
রফিউদ্দিন বলল, 'না, তুমি বিরোধী দলেই থাক। কারণ আছে।'
আবদুর রহমান জানতে চাইল, কী কারণ?
রফিউদ্দিন বলল, 'চিরদিন তো আর সরকারি দল সরকারে থাকবে না। বিরোধী দলও সরকারে আসবে। তখন তোমাকে কাজে লাগবে।'
আবদুর রহমান ইতিবাচক মাথা নেড়ে বলল, 'ঠিক বলেছ। তা ছাড়া তুমি আর আমি ঠিক থাকলে, কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না। তুমি সরকারি দলে থেকে আমাকে প্রটেকশন দেবে। আবার আমার দল যখন ক্ষমতায় যাবে তখন তোমাকে আমি প্রটেকশন দেব।'
রফিউদ্দিন বলল, 'এই তো আমার পলিসিটা ধরতে পেরেছ! তোমাকে দিয়ে হবে। শোন, এবার তোমাকে আরেকটা পরামর্শ দিই। রাজনীতিতে অর্থলগি্ন করার প্রয়োজন নেই, এটা ঠিক নয়। অর্থলগি্নর প্রয়োজন আছে।'
আবদুর রহমান তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, 'কী বলছ তুমি! আমরা কি ব্যবসা করব নাকি!'
আবদুর রহমানের কানের কাছে মুখ নিয়ে রফিউদ্দিন বলল, 'এখন তো রাজনীতি মানেই ব্যবসা! বুঝতে পারছ? তুমি উপজেলা সভাপতিকে মোটা অঙ্কের টাকা না দিলে তো নেতাই হতে পারবা না। সারা জীবন কর্মীই থাকতে হবে। নেতা না হলে তো কোনো কাজও পাবে না। তা ছাড়া উপজেলার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্যও তোমাকে টাকা ছড়াতে হবে।'
আবদুর রহমান তার বন্ধুর কথায় সায় দিয়ে বলল, 'কথাটা তো মন্দ বলনি! অবশ্য তুমি চিকন বুদ্ধিতে ওস্তাদ! বুদ্ধির মারপ্যাঁচ কিভাবে দিতে হয় তা তুমি ভালো জানো।'
রফিউদ্দিন বলল, 'শোন, আগে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ ভাগাতে হবে। এরপর দুজনে মিলেমিশে কাজ করব। কিন্তু সবাই জানবে তুমি আমার বড় শত্রু। মিছিল মিটিংয়ে তুমি আমার বিরুদ্ধে আর আমি তোমার বিরুদ্ধে গলাবাজি করব। কাজটা করতে হবে গোপনে। কেউ যেন টের না পায়।'
আবদুর রহমান বলল, 'সবাই যে জানে আমরা দুজন বন্ধু!'
রফিউদ্দিন কথা টেনে নিয়ে বলল, সে জন্যই তো দুজন দুই দলে ঢুকব। একজন আরেকজনকে বকাবাজি করব।
'মানুষ বিশ্বাস করবে তো?'
'আরে করব না কেন? অবশ্যই করব।'
তারপর দুই বন্ধু চাষের জমি বিক্রি করে টাকা ঢাললো রাজনীতিতে। রাজনীতিতে নেমেই তারা হয়ে গেল সরকারি ও বিরোধী দলের দুই নেতা। কী অবাক কাণ্ড! টাকার কাছে সবাই যেন হার মানল। দুই বন্ধু সরকারি ও বিরোধী দলের ওই উপজেলার নীতিনির্ধারক হয়ে উঠল। তারপর শুরু হলো দুই বন্ধুর নতুন মিশন! রফিউদ্দিন উপজেলার সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পাচ্ছে। যেনতেনভাবে কাজ করে প্রকল্পের টাকা আগাম তুলে নিচ্ছে। টাকা ছড়িয়ে সে সরকারি কর্মকর্তাদেরও হাত করে ফেলেছে। ফলে রফিউদ্দিনের এখন পোয়াবারো। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে সে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানাচ্ছে।
রফিউদ্দিন কারণে অকারণে হাসে। একে মারে ওকে ধরে। অর্থ হলে যা হয় আর কি! রফিউদ্দিনের চেহারাও খুলে যায়। স্বাস্থ্য এমনভাবে বাড়তে থাকে যে ৫০ কেজি ওজনের মানুষটি ৮০ কেজি হয়ে গেল। হাত-পায়ের আঙুলগুলোও বেঢপ টাইপের মোটা হয়ে গেল। টেকো মাথা তৈলাক্ত রূপ ধারণ করল। এলাকায় এখন রফিউদ্দিনকে নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। এই সেদিনও যে রফিউদ্দিন ঠিকমতো খেতে পেত না, সে এখন অনেক টাকার মালিক! ঘটনা কি! এত টাকা পেল কোথায় সে!
এলাকার লোকজন যখন টের পেল রফিউদ্দিনের বিত্তের উৎস কোথায়; তখন সবাই তাকে নিয়ে নানা ধরনের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে লাগল। এরকম বিদ্রূপ করতে করতে তারই এক শিক্ষক তাকে বলে বসল, রফিউদ্দিন, হঠাৎ তোমার আঙুল এত মোটা হলো কেন?
রফিউদ্দিন কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। সে কাচুমাচু করে বলে, স্যার, স্বাস্থ্যটা একটু ফিরতেছে। আগে তো চিকন চাকন ছিলাম। এখন মোটা হয়ে যাচ্ছি। শরীর মোটা হলে তো আঙুল মোটা হবেই!
শিক্ষক সাহেব টিপ্পনী কেটে বললেন, স্বাস্থ্যগত কারণ নাকি এর সঙ্গে বিত্তবৈভবেরও যোগ আছে?
রফিউদ্দিন আমতা আমতা করে বলল, কী জানি, থাকতেও পারে!
শিক্ষক সাহেব আবারও বললেন, তাই তো লোকজন তোমাকে 'মোটা আঙুল' বলে ডাকে। তুমি কি তা জানো?
রফিউদ্দিন শুনেও না শোনার ভান করে বলল, জি! কী বললেন? আমাকে কী বলে ডাকে?
শিক্ষক সাহেব আবারও বললেন, 'মোটা আঙুল।'
রফিউদ্দিন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শিক্ষক সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। চারদিক থেকে ওই শব্দটি সে শুনতে পাচ্ছিল। শব্দটি যেন তাকে তাড়া করছিল। সেই থেকেই রফিউদ্দিনের নাম হয়ে গেল 'মোটা আঙুল।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.