শ্রদ্ধাঞ্জলি-চিরঞ্জীব মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী by নোশীন লায়লা

মৃদুলকান্তি স্যার নেই। গভীর বেদনা নিয়ে মর্মে মর্মে অনুভব করে চলেছি এই নির্মম নিষ্ঠুর সত্যটি। তার পরও কেন যেন বিশ্বাস হতে চায় না। মন বলে, এভাবে এই মানুষটি চলে যেতে পারেন না। তিনি ছিলেন এক গভীর প্রাণময় সত্তা, হাজারো ছাত্রছাত্রীর নিত্য প্রেরণাদাতা, শিক্ষিত, পরিশীলিত ও স্বকীয়তায় ভরপুর এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারের অধীনে এমফিল করার পর পিএইচডির গবেষণায় নিয়োজিত ছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রিয় অফিসকক্ষে যতবার গেছি, ততবারই যেন মানুষটিকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। প্রতিবারই যেন নতুন কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। চোখের সামনে তাই বারবার ভেসে উঠেছে পেছনে ফেলে আসা অনেক পুরোনো দিনের স্মৃতি। আমার দীর্ঘ সংগীতজীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষের সাহচর্য মিলেছে। সেই সব গুণী মানুষের সবার কাছে আমি কোনো না কোনোভাবে ঋণী। তারপর কারও কারও স্মৃতি একটু বেশি মাত্রায় ভাবায়। তাঁদের কথা মনে হলেই দুচোখে জল গড়িয়ে আসে। তেমনি কজন মানুষ ছিলেন আমার ওস্তাদ কাদের জামিরী, ভাষাসৈনিক আবদুল লতিফ আর মৃদুলকান্তি স্যার। উজ্জ্বল হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতি ছড়াতেন এই মানুষগুলো। চলাফেরায় বাহুল্য নেই, শুধু প্রাণের টানে বয়ে চলা। তাই বুঝি তাঁদের এই অসামান্য লোকপ্রিয়তা!
আমার গবেষণার কাজে মৃদুলকান্তি স্যারের দ্বারস্থ হয়েছি অসংখ্যবার। প্রতিবার তাঁর মধ্যে লক্ষ করেছি নতুন কিছু দেওয়ার প্রত্যাশা। আমার প্রতিটি কথা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনতেন তিনি। তারপর শুরু হতো তাঁর কথা বলা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। কখনো আমার কোনো কথার যুক্তি খণ্ডাচ্ছেন, কখনো মূল্যবান সব তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করছেন আমাকে, কখনো বা উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠছেন প্রাসঙ্গিক কোনো গান। প্রয়োজনমতো যখন যা চেয়েছি, শত ব্যস্ততার মধ্যেও উজাড় করে দিয়েছেন। কখনো বাসায় বসে, কখনো তাঁর অফিসকক্ষে, কখনো বা ফোনে।
ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর প্রতিভা ছিল বহুমুখী। রাগসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, লোকসংগীত—সব ক্ষেত্রে ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। এই গুণী মানুষটির জন্ম ১৯৫৫ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জে। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা। ১৯৮০ সালে শান্তিনিকেতন থেকে বি.মিউজ ও ১৯৮২ সালে এম.মিউজ কোর্স কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৯৪ সালে বিশ্বভারতী থেকে ‘বাংলা সংগীতের ধারা ও লোকসংগীতের সুরে রবীন্দ্রসংগীত (অষ্টম থেকে বিংশ শতাব্দী)’ বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ও তাঁর বড় বোন রত্না ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গান গেয়ে বেড়াতেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ বুলেটিন বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে জমা দিতেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় গণমাধ্যমে ইনস্টিটিউট ও ফরেন সার্ভিস একাডেমি আয়োজিত সংগীত বিষয়ে পাঠদান ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে তাঁরই নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ চালু হয়। এখন সংগীত বিভাগ আলাদা হয়েছে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান পদে কাজ করেছেন। ২০০৩ সাল থেকে স্টুডেন্ট ইউনাইটেড ফর রিসার্চ ইন মিউজিক্যাল অ্যাকটিভিটিজের (সুরমা) সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
তাঁর রচিত হাসনরাজা, গানের তরী, বাংলা গানের ধারা, গানের ঝর্ণাতলায়, লোকসঙ্গীত, হাজার বছরের বাংলা গান, সঙ্গীত-সংলাপ প্রভৃতি বিচিত্র স্বাদের তথ্যসমৃদ্ধ বই সংগীতাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিভিশনে হাজার বছরের বাংলা গান নিয়ে গবেষণাধর্মী সংগীতানুষ্ঠান ‘বাংলা গানের ধারা’ অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার কাজে হাত দিয়েছিলেন তিনি। এর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পর্যায়ে বড়ু চণ্ডীদাসের একটি কীর্তন গাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
অসামান্য এই শিল্পী তাঁর হূদয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্থান সব সময়ই তৈরি করে রেখেছিলেন। সমাজ ও স্বদেশ চেতনা, উদারতা, আত্মসচেতনতা, মানবতা, দূরদর্শিতা আর মুক্তবুদ্ধির আশ্চর্য রকমের মিশেল তাঁর ব্যক্তিত্বে ধরা পড়ত; যা তাঁর প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর চিরপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর সংগীতবিষয়ক বিভিন্ন বক্তৃতা বা আলোচনাও এই ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। প্রচণ্ড স্পষ্টবাদী এই মানুষটির সাবলীল কথা বলা, তীক্ষ সমালোচনা আর সত্যভাষণ আমাদের সবার মনে অম্লান হয়ে থাকবে চিরদিন।
তিনি আর ফিরে আসবেন না আমাদের মাঝে। আর তাঁর মুঠোফোনে ‘মন তুই দেখ্না খুঁজে দেহের মাঝে’ গানটি বাজার পর ভরাট গলায় তিনি ‘হ্যালো’ বলে উঠবেন না। তার পরও তিনি তাঁর ভক্তদের ভালোবাসায় আর ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাচেতনায় অমর হয়ে থাকবেন। সৃষ্টিকর্তা তাঁর বিদেহী আত্মাকে শান্তি দিন—এই প্রত্যাশা সবার। কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে স্মরণ করে আরও একবার জানাই অপরিসীম ও আন্তরিক ভালোবাসা।
নোশীন লায়লা

No comments

Powered by Blogger.