লাদেনের মৃত্যু এবং 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' by শহিদুল ইসলাম

এক. ৩ মে, ২০১১ কালের কণ্ঠে গাফ্ফার ভাই লাদেনের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেন। সেই লেখায় তিনি চে গুয়েভারার নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি লাদেনের সঙ্গে চে গুয়েভারার তুলনা করেননি। কিন্তু যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। লাদেনের সঙ্গে গুয়েভারার একটা তুলনা হয়ে গেছে। হয়তো তাঁর অজান্তেই।


তিনি যে ভয় করেছেন, গুয়েভারার মতো লাদেনের ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি, জামা-কাপড় এখন মার্কিনবিরোধীদের গায়ে উঠবে, সেই ভয় তাঁর অমূলক। লাদেনের অনুসারী ধর্মান্ধগোষ্ঠীও সেই কথা বলেছে। 'লাদেনের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তাদের সংগ্রাম চলবে।' হ্যাঁ, চলবে। তাদের কথা মিথ্যা নয়। তারাও হয়তো লাদেনের ছবি আঁকা জামা-কাপড় পরে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে। হতেই পারে। কিন্তু গাফ্ফার ভাই যেভাবে বলেছেন, সেটা হবে না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়াই করে গুয়েভারা শেষে নিহত হয়েছিলেন। তাঁর মুখে কোনো সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ ছিল না; ছিল কেবল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কথা। তাঁর লড়াই ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদমুক্ত একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের। তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গণতন্ত্র এবং ইহজাগতিকতায় বিশ্বাসী মানুষের গায়েই কেবল গুয়েভারার ছবি আঁকা গেঞ্জি দেখা যায়। সারা বিশ্ব, এমনকি গাফ্ফার ভাইয়ের কথায়-খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় গুয়েভারাকে দেখা যায়। লাদেন এবং চে গুয়েভারা দুই জগতের মানুষ। চে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক-ইহজাগতিকতায় বিশ্বাসী। আর লাদেন কী, তা আজকের মানুষ ভালোভাবেই জানে। গাফ্ফার ভাই একজন মুসলমান। তিনি ওই লেখায় নিজেই বলেছেন, তিনি লাদেনের আদর্শে বিশ্বাসী নন। অর্থাৎ, লাদেন যে বিশ্বে ইসলাম কায়েম করতে চান, কোটি কোটি মুসলমান লাদেনের সেই আদর্শে বিশ্বাসী নয়। তাই ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে মানুষ চে'র পেছনে দাঁড়াতে পারে; লাদেনের পেছনে নয়। এমনকি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোটি কোটি মুসলমানও লাদেনের বিরুদ্ধেই কথা বলেন। কারণ তাঁরা জানেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মান্ধতা যমজ ভাই-একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই দেখুন না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে অবিভক্ত ভারতের উপনিবেশ-পীড়িত হিন্দু ও মুসলমানকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত ভারতবর্ষের মানুষের সাধারণ শত্রু যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, সেই কথাটি সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ঠিক তেমনি লাদেনপন্থীরা আজ বুঝতে পারছেন না, জানি না, বুঝতে পারছেন কি পারছেন না, সেই সাম্প্রদায়িকতা মুসলমানদের একটি বিরাট অংশকে তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। তাই তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধিতা কোনো দিনই সফল হবে না।
দুই. লাদেনপন্থী সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদগোষ্ঠী যতই বলুক তাদের 'সংগ্রাম' চলবে, সেটা যে সফল হবে না, সেটা তারা ভালোভাবেই জানে। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, তাদের মতাদর্শিক গুরু এবং অর্থ জোগানকারী সৌদির বাদশাহ কোনো দিনই সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধীদের কোনো মিছিল বা সভা-সমিতি করতে দেবেন না। কারণ, লাদেনপন্থীদের আশ্রয়স্থল সৌদির বাদশাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবাসী ভৃত্য। এই যদি হয় ইসলামের তীর্থস্থান সৌদি আরবের অবস্থা, তাহলে তারা এই যুদ্ধে কিভাবে জয়ের আশা করে? হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মানুষ কখনো লাদেনের ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বহু মানুষ আছে, বিভিন্ন জাতি, আদিবাসী আছে, যারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই সন্ত্রাস সমর্থন করে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রাসী ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের হিসাবটা বাইরে রাখতে হবে। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। যেমন-লাতিন আমেরিকায় ৫০ বছরের মার্কিনি বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর আজ তারা সাফল্যের মুখ দেখতে পারছে। আজ একের পর একটি দেশে মার্কিনবিরোধী জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্কসবাদী সরকার গঠিত হচ্ছে জনগণের ভোটে।
তিন. ওবামা যে ভাষণে অ্যাবোটাবাদ আক্রমণের কথা স্বীকার করে বলেছেন, ২০০১ সালে আমাদের সেই চূড়ান্ত ভারাক্রান্ত সময়ে আমেরিকার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল (কালের কণ্ঠ, ৩.৫.১১), তা সঠিক নয়। তিনি বলেছেন, আমরা কে কোথা থেকে এসেছি, কোন ঈশ্বরের উপাসনা করি, কে কোন সম্প্রদায়ের লোক-সব কিছু ভুলে ওইদিন আমরা এক আমেরিকান হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। কথাটা যে সত্য নয়, তার একটি মাত্র প্রমাণ হাজির করে আজকের লেখাটি শেষ করব। আমেরিকার আদিবাসীদের একজন উচ্চ শিক্ষিত উত্তরপুরুষ মাইকেল ইয়োলো বার্ডের একটি বড় উদ্ধৃতি পাঠকদের উদ্দেশে নিবেদন করব। এটা পড়ে পাঠক বুঝে নেবেন, বুশ ও ওবামার 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' আমেরিকার সবাই মনে-প্রাণে গ্রহণ করেনি।
'২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবি্লউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার আদিবাসী নেতারা তা সমর্থন করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, 'তারা যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করেছিল, কারণ সন্ত্রাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তাকে হিংসা (Jealous) করে এবং তারা গণতন্ত্রকে ঘৃণা করে।' আদিবাসী নেতারা তাঁদের যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, 'যারা আমাদের দেশ আক্রমণ করেছিল, সেসব ভীতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো এবং তাদের ধ্বংস করো।' সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির যে প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসে উঠেছিল, আদিবাসী নেতারা তা-ও সমর্থন করেছিলেন। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, 'আমরা আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধ করতে কখনো ভয় পাইনি; এবং যখনই প্রয়োজন হয়েছে, আমরা সব সময় আমাদের কর্তব্য পালন করেছি-আমরা আমেরিকার সেনাবাহিনীর কাজ করছি।' কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁরা বলেন, 'আমরা এই সরকারের জন্য যুদ্ধ করছি না। যেহেতু আমরাই এ জাতির আদি পুরুষ, সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধ করছি।' আদিবাসীদের সবাই বলেন না, তাঁরা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সমর্থন করেন বা করেন না। 'কেন যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হয়েছিল', তার কারণ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট যা বলেন, তা শুনে অনেক আদিবাসী বিদ্রূপের হাসি হেসেছিলেন। সেসব আদিবাসী নেতা যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করেন, অনেকেই তাঁদের ওপর ক্রুদ্ধ হন। তাঁরা বলেন, 'এ কথা সত্য যে, ১১ সেপ্টেম্বর যেসব নিরীহ-নির্বোধ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হয়েছিল, তা হলো এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের হত্যা করছে। এ ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন তারা অন্যান্য দেশেও চালিয়েছে-যারা দুর্বল, আমেরিকার উপনিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অক্ষম। ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।' তাঁরা আরো প্রশ্ন তোলেন, 'অন্য কোনো দেশ যদি তোমাদের দেশ আক্রমণ করে এবং নিরীহ নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করে, তোমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?' যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর উদ্দেশে প্রশ্ন তোলেন, 'তোমরা কি মনে কর, আমেরিকার ধনী সিনেটরদের ছেলেরা যুদ্ধক্ষেত্রে আদিবাসী সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে?' শেষে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেখানকার আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের মনোবেদনার কথা তাঁদের কণ্ঠে ভেসে ওঠে, 'দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে তুমি কি মনে কর, তারা তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে? তারা কি আমাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত দেবে, যে জমি তারা কেড়ে নিয়েছে? যেসব বৈষম্যমূলক চুক্তি করেছে আমাদের সঙ্গে, সেগুলো বাতিল করবে? যেদিন আমার ছেলেরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নাম লেখাবে এবং অন্য দেশের মানুষ মারতে যাবে, সেদিন আমি নরকযন্ত্রণা ভোগ করব। কারণ, এই ঔপনিবেশিক জাতি পৃথিবীর ওপর তার আধিপত্য বজায় রাখবে এবং ধনীকে আরো ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেবে।'
চার. গাফ্ফার ভাই তাঁর লেখার শেষে বর্তমান সরকারকে এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক লাদেনপন্থীদের সম্পর্কে সজাগ থাকার উপদেশ দিয়েছেন। কারণ, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা কেবল গণতন্ত্রের শত্রু নয়, মানবতাবাদেরও বড় শত্রু। তিনি চণ্ডীদাসের সেই বিখ্যাত উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন, যা লাদেনপন্থীরা বিশ্বাস করে না। 'সবার ওপরে মুসলমান সত্য, তাহার ওপরে নাই'-এটাই তাদের মূলমন্ত্র। এই মন্ত্রই দ্বাদশ শতাব্দীর পর মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ। এই মন্ত্রই আজও মুসলমানদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতেই হবে। গাফ্ফার ভাই তাঁর লেখায় বলেছেন, লাদেন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। সেই লাদেনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এটা নতুন কথা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর ওপর এক গবেষণামূলক বই লিখেছেন উইলিয়াম ব্লাম। বইটির নাম 'দ্য রোগ স্টেট' (The Rogue State)। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের কট্টর বিরোধীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক প্রেমের সম্পর্ক আছে। লাদেনকে মারলে কী হবে, যুক্তরাষ্ট্রের যেমন সৌদি বাদশার সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক আছে, তেমনি সৌদি আরবের অর্থে পুষ্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক লাদেনপন্থীদেরও এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে রয়েছে। পেন্টাগন প্রতিটি দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। সেটাই বর্তমান সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারে কাজে লাগায়। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সেই বিখ্যাত উক্তিটি পুনরুল্লেখ করে লেখাটি শেষ করি-'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয় না।' লাদেন জীবন দিয়ে আবারও সেই কথাটিই প্রমাণ করে গেলেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.