কালান্তরের কড়চ-মি. হাইডের চরিত্র ভ্রষ্টতা ও বিকৃতির আরো কিছু তথ্য by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

'যায়যায়দিন' পত্রিকার সাবেক সম্পাদক এবং বেগম খালেদা জিয়ার অঘোষিত (?) উপদেষ্টা শফিক রেহমান সম্পর্কে 'কালের কণ্ঠে' আমার দুই কিস্তির লেখাটা পড়ে ঢাকা থেকে আমাদের দুজনের এক কমন বন্ধু টেলিফোনে আমাকে বলেছেন, 'বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতে শফিক রেহমান কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যে, তাঁকে নিয়ে সপ্তাহের


পর সপ্তাহ তোমাকে কলাম লিখতে হবে?' আমার বন্ধুকে জানিয়েছি, শফিক রেহমান আমার লেখার লক্ষ্য নন, উপলক্ষ মাত্র। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য, পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের মতো বাংলাদেশেও সামরিক ও স্বৈরাচারী সরকারগুলো কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য চরম ধূর্ততার পরিচয় দেখিয়েছে এবং একসময় জনগণের কাছে পরম আস্থাভাজন ছিলেন_এমন একশ্রেণীর ব্যক্তিকে সে কাজে ব্যবহার করেছে, তা দেখানো। এই ব্যাপারে শফিক রেহমান, মতিউর রহমান, সিরাজুর রহমান (বিবিসির বাংলা বিভাগের সাবেক সাংবাদিক), হালে আতাউস সামাদসহ আরো অনেকে হচ্ছেন এই 'বাংলাদেশি গোয়েবলসীয় চক্রের' গুরু। এদের যেকোনো একজনের 'পূত জীবন-চরিত্র' নিয়ে লিখতে গেলে ব্যক্তির চেয়ে তাঁদের ষড়যন্ত্রটাই বড় হয়ে ওঠে এবং তাঁদের মিথ্যার জঞ্জাল সরাতে একটু সময় লাগে। সুকান্তের মতো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে হয়, 'আর কতো সরাবো এ মিথ্যার জঞ্জাল?'
শফিক রেহমান সম্পর্কে বিশেষভাবে লিখতে বসেছিলাম একটি কারণে। কারণটি হলো জামায়াতি কাগজ 'নয়াদিগন্ত'-এর ১১ জুন শনিবারের সংখ্যায় শফিক রেহমান একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন, শিরোনাম 'শেখ হাসিনার উল্টো অবস্থান।' শফিক রেহমান যত খুশি শেখ হাসিনার সমালোচনা করুন, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমারও নেই। শেখ হাসিনা একজন জীবিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর কাজের সমালোচনা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। গণতান্ত্রিক সমাজকে তা এগিয়ে দেয়, তার কোনো ক্ষতি করে না।
কিন্তু 'নয়াদিগন্ত'-এ প্রকাশিত খালেদা জিয়ার উপদেষ্টার নিবন্ধটি কোনো সমালোচনা নয়, জঘন্য মিথ্যাচার। এই ঢালাও মিথ্যা আবার দেশের কোনো উল্লেখযোগ্য জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হয়েছে 'নয়াদিগন্ত'-এর মতো জামায়াতি পত্রিকায়। যে জামায়াতের নামে একদা শফিক রেহমান ও সিরাজুর রহমান নাসিকা কুঞ্চন করতেন, এখন সেই জামায়াতি 'মিথ্যার জঞ্জাল-পত্রে' গিয়ে তাঁদের আস্তানা বাঁধতে হয়েছে। অন্য কোনো জাতীয় দৈনিক তাঁদের ঠাঁই দেয়নি। অথবা ঠাঁই হয়নি।
গল্পে আছে, এক গৃহস্থ বাড়ির সতীসাধ্বী স্ত্রী পতিতাপাড়ায় গিয়ে নাম লিখিয়েছিলেন। সবাই অবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি পতিতাপাড়ায় গেলেন কেন? সাধ্বী স্ত্রী বললেন, 'ভাই, আর বলবেন না। আমার স্বামীর বাড়িতে আর নামাজ-রোজা হয় না। তাই ওই বাড়ি ছেড়ে এলাম।' সম্ভবত শফিক রেহমান ও সিরাজুর রহমানেরা বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সৎ সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন না। তাই একাত্তরের ঘাতক দালাল, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতার শত্রুদের কাগজের কোলে উঠে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করেছেন।
'নয়াদিগন্ত'-এ প্রকাশিত শফিক রেহমানের বিকৃত খবর ভাষ্যের বিকৃতিগুলো দেখানোর জন্যই কলম ধরেছিলাম। কারণ, এই মিথ্যা ও অসৎ প্রচারণা দেশের গণতান্ত্রিকব্যবস্থা ও ভবিষ্যতের জন্য এতই ক্ষতিকর, তরুণ প্রজন্মের নাগরিকদের এই প্রচারণায় বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করা দরকার। কিন্তু শফিক রেহমান সম্পর্কে আমার লেখার দুই কিস্তি প্রকাশ না হতেই দেখি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ক্রিটিকদের বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দিয়ে ঢাকার জাতীয় দৈনিকগুলোর সোমবার, ২৭ জুনের সংখ্যায় 'ভালোর পসরা' নামে একটি বড়সড় নিবন্ধ লিখেছেন। বিদেশ সফরের এত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী কানাডার টরোন্টোয় বসে ২২ মে প্রবন্ধটি লেখার সময় ও সুযোগ পেয়েছেন।
তাতে আমি খুশি। এই প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ায় প্রমাণ হলো, শুধু দেশে নয়, বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর অতি ব্যস্ততার সময়েও দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার (পরিসংখ্যানসহ) সময় ও সুযোগ তাঁর আছে এবং তাঁকে এই লেখায় সাহায্য জোগানোর জন্য অনেক লেখক ও পণ্ডিতও তাঁর চারপাশে আছেন। আমি তাই 'নয়াদিগন্ত'-এ প্রকাশিত শফিক রেহমানের নিবন্ধটি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এবং চাই এই নিবন্ধটির মিথ্যাচার সম্পর্কে একটি জোরালো লেখা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে 'নয়াদিগন্ত'সহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে পাঠানো হোক। শফিক রেহমানকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তাঁর লেখার তথ্য ও সত্য বিকৃতি সম্পর্কে দেশের মানুষকে সতর্ক করা উচিত।
শফিক রেহমান ও সিরাজুর রহমানের মিথ্যাচারের মধ্যে একটা লক্ষণীয় পার্থক্য আছে। সিরাজুর রহমান ডাঁহা মিথ্যাকে সত্য বলে চালান। শফিক রেহমান ডাঁহা মিথ্যা লেখেন না। একটি সত্য খবর বা বক্তব্যকেই সঠিকভাবে উদ্ধৃত করে তার এমন বিকৃত ও অসাধু ব্যাখ্যা করেন, তা ডাঁহা মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন সিরাজুর রহমান গত মাসে লন্ডনের 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে একটি চিঠি লিখে দাবি করলেন, ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফেরার পথে লন্ডনে আসেন, তখন তিনি জানতেন না বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সিরাজুর রহমানই তাঁকে প্রথম কথাটা জানান। এ ছাড়া লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানাতে গিয়েছিলেন ব্রিটেনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থ। দুটি কথাই সর্বৈব মিথ্যা।
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পেঁৗছার আগেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল, পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো লায়ালপুরের জেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাঁকে জানিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে অন্তত পাকিস্তানের পতাকাটা রাখুক এবং কনফেডারেশন ব্যবস্থায় দুই দেশের সম্পর্ক টিকে থাকুক। বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছেন, 'আমি দেশে ফিরে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারব। এখন কিছুই বলতে পারব না।'
এরপর পাকিস্তান থেকে লন্ডনে দীর্ঘ প্লেন জার্নিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন সপত্নী ড. কামাল হোসেন। এ কথা এখন সবারই জানা, লাহোরে থাকার সময় ড. কামাল হোসেন কারাবন্দি ছিলেন না এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি জানতেন। তিনি প্লেনে ওঠার আগেই বঙ্গবন্ধুকে পরিস্থিতি জানাননি_এ কথা কোনো পাগলেও কি বিশ্বাস করবে? তা ছাড়া লায়ালপুর জেলের প্রধান কর্মকর্তাই বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার দিনই জেলে বঙ্গবন্ধুকে হিজ এঙ্েেলন্সি সম্বোধন করে তাঁকে খবরটা দিয়েছিলেন। এখন এত দীর্ঘকাল পর লন্ডনে বসে কোথাকার কে এক সিরাজুর রহমান দাবি করছেন, তিনিই দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটা প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন। কত বড় বাপের ব্যাটা তিনি!
লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসে সঠিক খবরটি গার্ডিয়ানকে জানিয়েছে এবং গার্ডিয়ান তা চিঠিপত্র কলামে প্রকাশ করেছে। লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাস থেকেও জানানো হয়েছে, ওইদিন ভারতের হাইকমিশনার লন্ডনের এয়ারপোর্টে যাননি। বঙ্গবন্ধু যে গাড়িতে হিথরো থেকে লন্ডনের হোটেলে এসেছেন তা ড্রাইভ করেছেন লন্ডনে নিযুক্ত বাঙালি কূটনীতিক রেজাউল করিম এবং গাড়িতে ছিলেন ড. কামাল হোসেনও। সিরাজুর রহমান তাঁর লেখায় একটি মিথ্যা নয়, আরো মিথ্যা লিখেছেন। তিনিও বিবিসি বেতারের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন খালেদা জিয়ার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং অনুগ্রহপ্রার্থী। গাঁজার নৌকা যে পাহাড় ডিঙাতে পারে, সিরাজুর রহমানের অধিকাংশ লেখাতেই তার প্রমাণ থাকে।
আগেই বলেছি, শফিক রেহমান ডাঁহা মিথ্যা লেখেন না, সত্যের বিকৃতি ঘটান। এই ব্যাপারে তাঁর ধূর্ততা ও পারদর্শিতা অসাধারণ। নয়াদিগন্তে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধটি থেকেই একটি উদাহরণ দেই। তিনি লিখেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে শেখ হাসিনা উল্টো পথ ধরেছেন। অর্থাৎ আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য চরম আন্দোলন করেছেন, আর এখন সেই ব্যবস্থা উল্টোতে চাচ্ছেন। খুবই সঠিক খবর। কিন্তু খবরের মাঝের খবরটুকু তিনি বেমালুম গায়েব করে গেছেন এবং খবরটিকে বিকৃত করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমে মাগুরা উপনির্বাচন এবং পরে ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব স্বীকৃত চরম জালিয়াতির সাধারণ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে ব্যাপক গণআন্দোলন তৈরি হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিলেও জামায়াতিদেরও এটা দাবি ছিল। দাবি ছিল ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্যান্য দলেরও। খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের দাবি মানেননি। উত্তাল গণআন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন। বর্তমানে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো গণআন্দোলন নেই। বিএনপি গণআন্দোলন করতে চাইছে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
শফিক রেহমান পরিস্থিতির এই পটভূমি সম্পূর্ণ গায়েব করে দেখাতে চেয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে শেখ হাসিনা এখন উল্টো অবস্থান নিয়েছেন। তা যদি সত্য হবে, তা হলে তাঁর প্রাণের নেত্রী খালেদা জিয়ার এখনকার অবস্থানটা কি? তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কঠোর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না (কথাটা কি শফিক রেহমানই তাঁর নেত্রীকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন?)। এখন ২০১১ সালে সেই খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রেমে পাগল এবং শিশু ও পাগল খুঁজে প্রায় বেদিশা। এটা কী আরো বড় ধরনের উল্টো অবস্থান নয়?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময়ই বলা হয়েছিল এটা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়, তখনকার বিশেষ অবস্থায় অর্থাৎ বিএনপির ক্রমাগত নির্বাচন জালিয়াতির জন্য এটা দরকার হয়েছিল। এখন সেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন থেকে নানা ধরনের নির্বাচনে (এমনকি বর্তমান পৌরনির্বাচনেও প্রমাণিত হয়েছে নির্বাচনে কারসাজির সুযোগ এখন কম। সুতরাং এই ব্যবস্থার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। এ ছাড়াও দু'দুবার বিএনপির চক্রান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এতটা দূষিত হয়েছে যে, এই ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের গণতান্ত্রিক মানুষ শঙ্কিত।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন সংসদে পাসের সময় বিরোধীদলের অনুপস্থিতির সুযোগে বিএনপি এই আইনে প্রতিরক্ষা দপ্তর রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে বলে অসৎউদ্দেশ্যে একটি বিধান ঢুকিয়ে যায়। তার বলে বলীয়ান হয়ে বিএনপি তার মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের মাধ্যমে দেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কী ধরনের বেকায়দায় ফেলেছিল দেশের মানুষ কি এত শিগগিরই ভুলে গেছে? একটি বিশেষ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে পরিচালিত এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শফিক রেহমানের কি যোগসাজশ ধরা পড়েনি? সে কথায় পরে আসছি।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের আমলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও কি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান ওরফে শান্তি মিয়ার পেছনে বিএনপির অশুভ ও অসাধু কলকাঠি নাড়াচাড়া দেখা যায়নি?
রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীনের সংসদ উদ্বোধনকালে বেগম জিয়া তা বয়কট করেছিলেন? ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে দেখা গেল তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঘন ঘন দেখা করছেন, তাঁর অনুরাগী হয়ে উঠেছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি এক দিনের জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েও বেগম জিয়া বসে আছেন। বিদায়ী সরকারের প্রধানের কোনো দাবি, কোনো পরামর্শই রাষ্ট্রপতি বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান শুনছেন না। তাঁদের প্রধান কনসান্স-কিপার তখন বিএনপির ডা. বদরুদ্দোজা, মান্নান ভূঁইয়া, বিএনপিপন্থী ব্যারিস্টার ইশতিয়াক প্রমুখ। এর পরের ঘটনা দেশের মানুষের সবারই জানা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পচন ঘটনায় বিএনপি-মনোনীত রাষ্ট্রপ্রধান (যাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের সর্ব নিকৃষ্ট রাষ্ট্রপতি) অধ্যাপক ইয়াজউদ্দীন আহমদ। তাঁর পেছনেও যে কলকাঠি নেড়েছেন বেগম জিয়া ও তাঁর 'সুযোগ্যপুত্র' তারেক রহমানের হাওয়া ভবন, তা আজ ওপেন সিক্রেট। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে সম্পূর্ণ কলুষিত করার পর সেই ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে এখন বিএনপির মরাকান্নার রহস্য কাউকে কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
শফিক রেহমান তাঁর বিরুদ্ধে জামায়াত ও এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে শুধু খবর বিকৃতি নয়, নিজের মানসিক বিকৃতিরও পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালের গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগের প্রধান সহযোগী কেন, সহযোগীও জামায়াত ছিল না। আওয়ামী জোটে জামায়াতকে গ্রহণ করা হয়নি। জামায়াত নিজের গরজে ওই আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়ে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে পিছু পিছু এসেছে। জামায়াতকে স্বাধীনতার শত্রু এবং যুদ্ধাপরাধী জেনেও ক্ষমতার ভাগিদার করেছে বিএনপি। জামায়াত নেতাদের এখন আওয়ামী লীগ বিনা বিচারে বন্দি করেনি, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের বিচারের চূড়ান্ত ব্যবস্থা ঘোষিত হয়েছে। এই যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতার শত্রুদের পক্ষে এখন কলম ধরেছেন শফিক রেহমান। মানুষের অধঃপতনেরও একটা সীমা থাকে।
এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বর্তমান সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে শফিক তাঁর লেখায় খোঁচা মেরেছেন। এটাও অসৎ খোঁচা। আওয়ামী লীগকে খুনখারাপি দ্বারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেননি জেনারেল এরশাদ। তিনি উৎখাত করেছিলেন বিএনপি সরকারকে। খালেদা জিয়ার বাড়িতে গিয়ে দরোজায় লাথি মেরেছিল এরশাদের পুলিশ এবং এরশাদের পুলিশের ভয়ে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে পালিয়ে দুই রাত নিখোঁজ থাকতে হয়েছিল। সর্বোপরি খালেদা জিয়া সন্দেহ করেন, তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানকে হত্যার পেছনে এরশাদও ছিলেন। এর পরও খালেদা জিয়া ক্ষমতার লোভে জেনারেল এরশাদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গঠন করেছেন, তাঁকে মঞ্চে নিয়ে সভা করেছেন। এমনকি তাঁর ছেলে তারেক টাকার বান্ডিল হাতে বাবরকে নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তাঁকে বিএনপি জোটে রাখার জন্য সাধাসাধি করেছেন। আর এখন দোষ হলো আওয়ামী লীগের! শফিক রেহমানদের কাছে আঙুর ফল এখন টক।
এই লেখার গত কিস্তিতে বাংলাদেশের একটি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে শফিক রেহমানের গোপন যোগাযোগের কথা লিখেছিলাম। এ সম্পর্কে আমার সন্দেহ পাকা হয় জাস্টিস হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের প্যালেস ক্যু ঘটানোর (জেনারেল মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীর একাংশের সহযোগিতায়) ষড়যন্ত্রের সময়। বিশেষ সামরিক গোয়েন্দা চক্রটি এ সময় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যেসব টেলিফোন-কথোপকথন হয়, তা আড়ি পেতে (টেলিফোন টেপিং) রেকর্ড করেছিল। সেগুলো অগ্রিম কিভাবে শফিক রেহমানের হাতে গিয়ে পেঁৗছেছিল এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন, সে রহস্য এখনো রয়ে গেছে। তিনি সে সম্পর্কে 'স্পিকটি নট'। আজ আপাতত শফিক রেহমাননামা এখানেই শেষ করি।
লন্ডন, ২৭ জুন, সোমবার ২০১১

No comments

Powered by Blogger.