কল্পকথার গল্প-আদি ও অকৃত্রিম সেই নন্দ ঘোষ by আলী হাবিব

ঘোষকুলে তিন ঘোষকে আমরা পাই। এক ঘোষ হচ্ছেন আয়ান ঘোষ। অন্য দুজন নন্দ ঘোষ ও হরি ঘোষ। পুরাণ মতে, আয়ান ঘোষ ছিলেন শ্রীরাধিকার স্বামী। তিনি একদা ছিলেন ঋষি। কোনো একসময় তপস্যায় বসেছিলেন। নারায়ণ তখন ঋষির বেশে তাঁর সামনে এসে হাজির হলেন। জানালেন, আয়ানের তপস্যায় তিনি সন্তুষ্ট। বর দিতে চান।


আয়ান কী বর চান? ঋষি আয়ান এই বর প্রার্থনা করলেন, নারায়ণের লক্ষ্মী যেন তাঁর স্ত্রী হন। নারায়ণ বর দিলেন। তবে জানিয়ে দিলেন যে পরজন্মে দ্বাপর যুগে তিনি লক্ষ্মীকে স্ত্রী হিসেবে পাবেন। কিন্তু লক্ষ্মীকে স্ত্রী হিসেবে পেতে হলে তাঁকে ক্লীব হয়ে জন্মাতে হবে। দ্বাপর যুগে লক্ষ্মী বৃষভানুরাজার কন্যা রাধিকা হয়ে জন্ম নিলেন। আয়ানের সঙ্গে রাধিকার বিয়ে হয়ে গেল। এই আয়ান ঘোষ ও রাধিকাকে নিয়ে অনেক গল্প আছে। কিন্তু নন্দ ঘোষ? পুরাণে এক নন্দকে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা। তখন কংস রাজার যুগ। এই নন্দের স্ত্রীর নাম যশোদা। কথায় কথায় আমরা বলি, 'যত দোষ নন্দ ঘোষ!' নির্দোষ কারো ঘাড়ে দোষ চাপানো হলে, তাকেই 'নন্দ ঘোষ' হিসেবে অভিহিত করা হয়। যেকোনো কারণে নির্দোষ কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে আমরা বলি, 'যত দোষ নন্দ ঘোষ।' 'হরি ঘোষের গোয়াল'খ্যাত হরি ঘোষকে আরেকদিন খোঁজা যাবে। আজ আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কে এই নন্দ ঘোষ?
এমনটি হতে পারে যে নন্দ ঘোষের পালিত পুত্র কৃষ্ণ শৈশবে ননী চুরিতে হাত পাকিয়েছিলেন। ফলে যেকোনো চুরির দায়ে এই নন্দ-নন্দনকেই হয়তো দায়ী করা হতো। বিশেষ করে তাঁর যৌবনের লীলার বিষয়টি তো ছিলই। কাজেই পালিত পুত্রের অপরাধে পালক পিতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো হয়তো। সে কাহিনী সরিয়ে রেখে নন্দ ঘোষকে নিয়ে কল্পগল্প তৈরি করা যেতে পারে। ধরা যাক, ওয়ান্স আপন এ টাইম, কোথাও নন্দ ঘোষ নামে কোনো এক মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কারো অনিষ্ট দেখতে পারতেন না। নির্দোষ কোনো ব্যক্তিকে সাজা পেতে দেখলে তাঁর মন খারাপ হতো। তিনি সেখানে ছুটে যেতেন। নির্দোষ ব্যক্তিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু সে আমলে, ধরে নেওয়া যেতে পারে, সময়টা রাজ-রাজড়াদের আমল_সে আমলে কাউকে তো আর বেকসুর ছেড়ে দেওয়া যায় না। কাজেই নির্দোষ নিরীহ ব্যক্তিকে ছাড়াতে গিয়ে অনেক সময় নন্দ ঘোষ নিজেই নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়ে নিতেন। এভাবে একের পর এক নিজের ঘাড়ে দোষ নিতে গিয়ে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে কোথাও কিছু ঘটলেই আমাদের গল্পের এই নন্দ ঘোষকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো। কোথাও কোনো গ্রামে চুরি হয়েছে? 'বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর' থিওরিতে ধরা হতো নন্দ ঘোষকে। অর্থাৎ আমাদের গল্পের এই নন্দ ঘোষ ছিলেন সব দোষের কমন দোষী।
গল্পটা আরো একভাবে সাজানো যেতে পারে। শুরুটা আবার সেই 'ওয়ান্স আপন এ টাইম' দিয়েই হবে। সেই সময়ে কেউ একজন নন্দ ঘোষ ছিলেন। এই নন্দ ঘোষ সমাজ নিয়ে খুব ভাবতেন। ভাবতেন সমাজের ভালোমন্দ নিয়ে। নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াতেন। কেমন করে সমাজের মঙ্গল হবে, এসব কথা বলে বেড়াতেন। তরুণদের ভালো পথে চলার উপদেশ দিতেন। কিন্তু সমাজে তো এমন কিছু মানুষ সব সময় পাওয়া যায়, যারা ভালোটাকে ভালোভাবে নিতে পারে না। নন্দ ঘোষের এই উপদেশ বিতরণ তাদের ভালো না লাগারই কথা। তো, দেখা গেল সমাজের ভালো কিছু করতে গিয়ে মন্দ ঘটে গেল। অমনি দোষটা গিয়ে পড়ল এই নন্দ ঘোষের ওপর! 'যা কিছু হারায় গিনি্ন বলেন, কেষ্টা ব্যাটাই চোর'_অনেকটা সে রকমই সব দোষ গিয়ে পড়ত নন্দ ঘোষের ওপর। কারো বাড়িতে চুরি হয়েছে, কে দায়ী? নন্দ ঘোষ। পাড়ার কোনো মেয়ে কোনো এক ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে, কে দায়ী? নন্দ ঘোষ। কারো ছেলে বিপথে চলে গেছে, কে দায়ী? নন্দ ঘোষ। সে আমলে এ আমলের মতো ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি ছিল না। থাকলে সে দোষেও হয়তো দোষী হতে হতো বেচারা নন্দ ঘোষকে। বিচারে কোনোদিন এই নন্দ ঘোষকে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছিল কি না, সেটা তো আর আমাদের জানা নেই। জানা থাকারও প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার একটা নন্দ ঘোষ, যার কাঁধে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়_তেমনটি পেয়ে গেলে তো আর সমস্যা থাকে না। নন্দ ঘোষ চাই, পেয়ে গেলেই হলো।
সময় এখন পাল্টে গেছে। আমরা অনেক আধুনিক হয়েছি। সে আমলের সেই নন্দ ঘোষের কাল এখন হয়তো নেই। কিন্তু নন্দ ঘোষকে মুছে ফেলা যায়নি। মুছে ফেলা বোধ হয় যাবেও না। প্রতীক হিসেবে নন্দ ঘোষকে পাওয়া যাবে। কথায় কথায় উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা হয় নন্দ ঘোষকে। নতুন নতুন নন্দ ঘোষ তৈরি করা হয়। সিরাজদ্দৌলার চরিত্রে যেমন একেক সময় এক একজনকে অভিনয় করতে দেখা গেছে, তেমনি নন্দ ঘোষ হিসেবে একেক সময় একেক জনকে ধরা হয়। এই নন্দ ঘোষদের বলা যেতে পারে সময়ের নন্দ ঘোষ। কাউকে বা কোনো কিছুকে একবার নন্দ ঘোষ সাজাতে পারলেই মোক্ষম প্রাপ্তিযোগ হয়ে গেল। আর কিছু লাগবে না। এই নন্দ ঘোষের ওপর দিয়ে অনেক দোষ পার করে দেওয়া যাবে।
সরকারের নন্দ ঘোষ বিরোধী দল। বিরোধী দলের নন্দ ঘোষ সরকার। ধরা যাক, বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে, কার দোষ? কে নন্দ ঘোষ? সরকার। সরকার বিরোধী দলের কোনো কথাই শুনছে না, বাধ্য হয়েই বিরোধী দলকে হরতাল ডেকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে হচ্ছে। প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে। আবার ধরা যাক, সরকার দেশের উন্নতি করতে পারছে না। কার দোষ? কে নন্দ ঘোষ? বিরোধী দল। সব সরকারের কাছেই কিছু গৎবাঁধা কথা থাকে। কেমন কথা? বিরোধী দল সহযোগিতা করছে না বলেই দেশের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আবার কখনো কখনো এমনটিও বলা হয়, বিরোধী দলের কাছ থেকে দেশের উন্নয়নে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
কোনো কোনো সময় মিডিয়াও নন্দ ঘোষ হয়ে যায়। তখন যত দোষ সব এই মিডিয়া নন্দ ঘোষের ওপর চাপানো হয়। জোট আমলে তো মিডিয়াকে নন্দ ঘোষ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। ক্রসফায়ার আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, কার দোষ? মিডিয়া হয়ে গেল নন্দ ঘোষ। জঙ্গিবাদের খবর চারদিকে চাউর হয়ে গেল, কার দোষ? মিডিয়া এখানেও নন্দ ঘোষ। কেন? মিডিয়ার কারণেই নাকি জঙ্গিবাদের আতঙ্ক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। মিডিয়াকে নন্দ ঘোষ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা যে থেমে গেছে, তা নয়।
সামাজিক-রাজনৈতিক নন্দ ঘোষের পাশাপাশি সংসারেও নন্দ ঘোষ খুঁুজে পাওয়া যাবে। সাদা চোখে তো দেখাই যায়, স্ত্রীর চোখে স্বামী নন্দ ঘোষ। বড় কর্তার কাছে ছোট কর্তা নন্দ ঘোষ। ছোট কর্তার কাছে কেরানি বাবু নন্দ ঘোষ। এমন কত নন্দ ঘোষ আমাদের চার পাশে! কাউকে আমরা দেখতে পাই, কাউকে দেখতে পাই না। কিন্তু তাই বলে নন্দ ঘোষকে ইতিহাসের পাতা থেকে, সমাজ ও সংসার থেকে মুছে ফেলা যাবে না। আজকের দিনে যাঁরা সংসার চালান, তাঁরা জানেন, বাজার কী বস্তু! বাজারে গিয়ে ব্যাজার মুখে ফিরতে হয় না, এমন লোকের সংখ্যা একেবারে যে নেই, তা নয়। তবে তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা। বাজার থেকে যাঁরা ব্যাজার মুখে ফিরে গৃহে স্ত্রীর কাছে মুখ ঝামটা খেয়ে তেতো মুখে অফিসমুখো হন, তাঁদের কাছে নন্দ ঘোষ হচ্ছে বাজার। বাজার কেন নন্দ ঘোষ? বাজারের কী দোষ! দাম বাড়ছে। না বেড়ে যদি স্থিতিশীল থাকে, সেটাও সাধারণের আয়ত্তের বাইরে। কাজেই বাজার করতে যাওয়া লোকের কাছে বাজার হচ্ছে আজকের দিনের নন্দ ঘোষ। এক নন্দ ঘোষের কত রকমের বিবর্তন!
নন্দ ঘোষের বিবর্তনে নতুন নন্দ ঘোষ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে, তাই। নতুন এই এক নন্দ ঘোষ, আন্তর্জাতিক বাজার, আমাদের ধরা ও ছোঁয়ার বাইরে। আমাদের বাজারে মূল্যস্ফীতি কেন? কে নন্দ ঘোষ? আন্তর্জাতিক বাজার। না, আমাদের কোনো দোষ নেই। আমরা বাজার সিন্ডিকেট দমন করতে পারিনি। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার মুখে লাগাম দিতে পারিনি। তেল-চিনি, চাল-ডাল_কোনো কিছুর দামই কমাতে পারিনি। কেন? কে নন্দ ঘোষ? আন্তর্জাতিক বাজার।
আদি ও অকৃত্রিম নন্দ ঘোষ এখনো সমাজে ও সংসারে বহাল তবিয়তে। নতুন এই নন্দ ঘোষের আছর থেকে কবে আমাদের মুক্তি মিলবে, সে কথাটা যদি কোনো নন্দ-নন্দন আমাদের বলে দিতে পারতেন!

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.