এক মঞ্চে পুরস্কার নিলেন ছাত্র-শিক্ষক by মশিউল আলম

শুক্রবার বলে বইমেলায় ভিড় বেশি হবে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সেদিকে যেতে রাজি হলেন না কয়েকজন সিএনজিচালক। কিন্তু বেলা আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের চত্বর পেরিয়ে বাংলা একাডেমীর দিকে এগোলে দেখা গেল, সড়কে ভিড় নেই। যাঁরা সকালের দিকে বইমেলায় এসেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছেন।


হাতে বইয়ের প্যাকেট দেখে বোঝা যায়, তাঁরা বইমেলায় এসেছিলেন বই কিনতেই, দেখতে বা বেড়াতে নয়। তাঁদের অধিকাংশই মেলায় এসেছিলেন শিশুদের নিয়ে।
মেলার ভেতরেও ফাঁকা ফাঁকা ভাব। তবে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা বই কিনছেন। শিশুরা চোখে পড়ে বেশি। তারা এক দোকান থেকে অন্য দোকানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মা-বাবাকে; কিনছে প্রিয় লেখকদের বই। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আনিসুল হকের বই খুঁজে খুঁজে কিনছে তারা। কিন্তু কোলাহল নেই, প্রীতিকর শান্ত পরিবেশ। বর্ধমান হাউসের পাশের গাছে একটা কোকিল ডাকছে।
২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে বই কেনা বেড়েছে—এমন কথা জানা গেল কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থার স্টলে। প্রথমার বিক্রয়কর্মীরা বললেন, দুপুর পর্যন্ত বিক্রির লক্ষণ দেখে তাঁরা নিশ্চিত, বই বিক্রি আগের দিনের চেয়ে বেশি হবে। অবসর ও সাহিত্য প্রকাশের স্টলের কর্মীদেরও একই প্রত্যাশা। সামনের কয়েকটি দিন শুধু বই কেনার জন্যই মানুষ বইমেলায় আসবে।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বইমেলার মূল মঞ্চের সামনের চেয়ারগুলো ভরে যায়। কিছুক্ষণ পরে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মাইকে বলেন, বাংলা একাডেমী পুরস্কার হস্তান্তরের কোনো অনুষ্ঠানে দর্শকদের এমন বিপুল উপস্থিতি তিনি এর আগে কখনো দেখেননি। সাহিত্যের নয়টি শাখায় মোট ১০ জন পেয়েছেন ২০১১ সালের বাংলা একাডেমী পুরস্কার—এই ঘোষণা এ মাসের ১১ তারিখেই দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তাঁরা উপস্থিত হয়েছেন, কেউ কেউ সপরিবারে। দর্শকদের মধ্যেও কবি-লেখকদের অনেকে উপস্থিত। তাঁদের একজন আবিষ্কার করলেন, পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে আলী আসগর যেমন আছেন, তেমনি আছেন তাঁর ছাত্র আনিসুল হক; আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ছাত্র আছেন দুজন—কবি কামাল চৌধুরী ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ। শামসুজ্জামান খান তাঁর সূচনা বক্তৃতায় বললেন, পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীর সভাপতি বা মহাপরিচালক, কারোরই কোনো হাত নেই। তিনি মন্তব্য করলেন, এবারের পুরস্কার হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে এত বেশি মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে এবারের পুরস্কার প্রদান সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছে।
বাংলা একাডেমী পুরস্কারের মর্যাদা এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছে। পুরস্কার ঘোষণার খবর আগে দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় পুরস্কারপ্রাপ্তদের ছবিসহ স্থান পেত; এখন তা হয় না। আগের বছর কারা পুরস্কার পেয়েছেন, লেখালেখির জগতের মানুষেরাই তা স্মরণ করতে পারেন না। এবার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা আলী আসগরের মতো লেখকদের এই পুরস্কারে ভূষিত করার ফলে খোদ পুরস্কারটির মর্যাদা যদি কিছু বাড়ে—এমন মন্তব্য করলেন একজন।
বিকেল চারটার পর মেলায় ভিড় বাড়তে শুরু করে এবং সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মানুষের ভিড়ে, তাদের পায়ের ধুলায় ও কোলাহলে বইমেলা হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থেই শুক্রবারের বইমেলা। সাড়ে পাঁচটার দিকে দেখা গেল মুহম্মদ জাফর ইকবাল বটতলায় বসে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। সেখানে যথারীতি ভিড়। কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত আনিসুল হক পুরস্কার হস্তান্তর অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মা, স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে মেলায় ঢোকার জন্য মানুষের লাইন দীর্ঘায়িত হলো ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের চত্বর পর্যন্ত। বাংলা একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেল, দিনের বিক্রি তিন লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, এটা আগের দিন বৃহস্পতিবারের চেয়ে বেশি। হুমায়ূন আহমেদের ছয়টি বই মেলায় এনেছে অন্যপ্রকাশ, বই বিক্রি তাদের স্টলেই সবচেয়ে বেশি—এ রকম দাবি করা হলো অন্যপ্রকাশের স্টলে, কিন্তু তারা টাকার অঙ্কটি জানাল না।
তরুণদের বই প্রকাশ করে ইতিমধ্যে বেশ নাম করেছে শুদ্ধস্বর নামে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা। তাদের প্রকাশিত কয়েকটি বই ইতিমধ্যে পুরস্কৃত হয়েছে। শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী বললেন, বই বিক্রি আগের বছরের তুলনায় এবার কম হয়েছে। একই রকম কথা জানা গেল আরও কয়েকটি স্টলে। তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিভিশন ইত্যাদির প্রসারের ফলে বই কেনা ও বই পড়া কমে যাচ্ছে কি না—এমন প্রশ্ন করা হলে কেউ কেউ বলেন, কিছু একটা হতে পারে। তবে শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ চৌধুরীর মন্তব্য, মানুষের আর্থিক অবস্থা এখন ভালো নয়।
যাঁরা পুরস্কার পেলেন: কবিতায় যৌথভাবে অসীম সাহা ও কামাল চৌধুরী, কথাসাহিত্যে আনিসুল হক, প্রবন্ধে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, গবেষণায় বিশ্বজিৎ ঘোষ, অনুবাদে খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে বেলাল মোহাম্মদ, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনিতে বরেণ চক্রবর্তী, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও পরিবেশে আলী আসগর এবং শিশুসাহিত্যে আখতার হুসেন। প্রতিটি শাখায় পুরস্কারের অর্থমান এক লাখ টাকা।
বিগত বছরগুলোতে সাহিত্যের ছয়টি শাখায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হলেও এ বছর থেকে ১০টি শাখায় পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে একাডেমী কর্তৃপক্ষ। তবে নাটক বিভাগে এ বছর কাউকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়নি। এ ছাড়া সকালে শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.