স্থানীয় সরকার-গরিব মানুষের বিচার পাওয়ার উপায় কী? by তোফায়েল আহমেদ

প্রচলিত আইন অনুযায়ী, বেআইনি কাজের প্রতিকারের জন্য আদালতের সুরক্ষা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ দেশের আদালত বা বিচারালয়ের বিন্যাস এতই শহরকেন্দ্রিক যে তাতে দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ, যারা জেলা শহরের বাইরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, তাদের পক্ষে আদালতের চৌকাঠ পেরোনো খুব একটা সহজ হয় না।


বেআইনি হস্তক্ষেপের শিকার ব্যক্তি বা পরিবারটি যদি গরিব, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ হন, তাঁদের পক্ষে শহরাশ্রয়ী বিচারালয় পর্যন্ত পৌঁছানো আরও অনেক বেশি কঠিন। বিচার-পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার জটিলতার প্রশ্ন বাদ দিলেও শুধু বসবাসস্থল থেকে ভৌত দূরত্বের কারণে ভুক্তভোগীদের অনেকেই আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। হাতে গোনা ১০-১২টি উপজেলা ব্যতীত দেশের সর্বত্রই আদালত-ব্যবস্থা জেলা পর্যায়ে এসেই থেমে আছে। অথচ জেলা কেন্দ্র থেকে দেশের জেলাগুলোর প্রান্তসীমার দূরত্ব কোথাও কোথাও শত মাইলেরও বেশি। জেলার নিচে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত সরকারের অন্য দুটি অঙ্গ আইন ও নির্বাহী বিভাগের সংগঠন ও সেবা বিস্তৃত হলেও সেখানে বিচার বিভাগ অনুপস্থিত। ফলে দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ, বিশেষত গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আইন-আদালতের সুরক্ষা চাদরের বাইরেই অবস্থান করছে।
বিচারব্যবস্থার জটিলতা ও আদালত কাঠামোর অতি সনাতনী ও কেন্দ্রীকৃত বিন্যাসের কারণে সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা নিজে থেকেই নানা সংকটের সম্মুখীন। দেশের আদালতসমূহে ভয়াবহ মামলাজট—যা গত বছর পর্যন্ত ছিল ২২ লাখের কাছাকাছি—এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে ছাড়া কমছে না। পুলিশপ্রধানের ভাষ্যমতে, সারা দেশের থানাসমূহে ২০১১ সালে এক লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৭টি মামলা দায়ের হয়। তার মাত্র ২৪ শতাংশ মামলার অভিযোগ প্রমাণ করা গেছে, বাকি ৭৬ শতাংশ অভিযোগের প্রমাণ সংগ্রহে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে (প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। বেশির ভাগ পুলিশি মামলা দুর্বল তদন্ত, দীর্ঘসূত্রতা ও সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে দুর্বল ও বাতিল হয়ে যায়। মামলাসংক্রান্ত এসব সমস্যার প্রতি আদালত স্থায়ীভাবে উদাসীন ও অন্ধ থাকতে পারেন না। আদালতের আশ্রয় না পাওয়া এভাবে প্রান্তিক মানুষের বিধিলিপি হয়ে গেলে সমাজে বিভিন্নমুখী অস্থিরতা বেড়ে যাবে; সত্যিকার অর্থে সমাজে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। তাই জেলার নিম্নস্তর উপজেলা পর্যন্ত অন্তত আদালতের সম্প্রসারণ এবং সামগ্রিকভাবে দেশে বিচারব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আশু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

২.
দেশের গ্রামীণ গরিবদের বিচারের সুবিধাদানের নামে আইন মন্ত্রণালয় ও আদালতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ‘গ্রাম আদালত আইন ২০০৬’-এর অধীনে ইউনিয়ন পরিষদকেন্দ্রিক একটি ‘গ্রাম আদালত’-ব্যবস্থা বিদ্যমান। এ আইনের অধীনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি কার্যবিধির বেশ কিছু ধারাবলে মামলা রুজু করার বিধান রয়েছে। মামলার আবেদন করা, মামলা নথিবদ্ধ করা, বাদী-বিবাদীকে সমন দেওয়া, সাক্ষ্যগ্রহণ, ‘হলফনামা আইন ১৮৭৬’ অনুযায়ী হলফ পাঠ করানো, লিখিতভাবে মামলার রায় প্রদান ইত্যাদির সুনির্দিষ্ট বিধান এ আইনে রয়েছে। ‘গ্রাম আদালত’ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানাও আরোপ করতে পারে।
সম্প্রতি ‘গ্রাম আদালত’কে ঘিরে ‘এক চেয়ারম্যানের নিজস্ব আদালত’ শীর্ষক চাঞ্চল্যকর একটি সচিত্র প্রতিবদন প্রকাশিত হয়েছে (প্রথম আলো, ৮-০১-২০১২)। পত্রিকার এ প্রতিবেদনটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে আদালতের নজরে আনা হলে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কার্যকলাপকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, এ মর্মে রুল জারি করেন। গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক, গাইবান্ধা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, গাইবান্ধার ডিসি ও এসপিকে আদালতে হাজির হতে এবং ইউপি চেয়ারম্যানকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ২২ জানুয়ারি (২০১২) বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ মামলার শুনানি হয়। নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান আদালতে আরজি দাখিল করেন এবং ২০ মিনিটকাল শুনানিতে আদালত আরজি গ্রহণ করে তাঁকে ‘সতর্ক’ করে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে রুলের নিষ্পত্তি করেন। এভাবেই ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এ ‘গ্রাম আদালত নাটক’ ২২ জানুয়ারি সমাপ্ত হয় (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০১২)। এ রকমের আরও একটি ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া দক্ষিণের ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ খানকে ৭ ফেব্রুয়ারি একই আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে (সাপ্তাহিক আমোদ, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২)।
এসব ঘটনার সূত্র ধরে ‘গ্রাম আদালত আইন ২০০৬’ এবং গ্রাম আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে আদালত থেকে আরও গভীর, বিস্তৃত ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আশা করা হচ্ছিল। রুল নিষ্পত্তি করে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, একটি উচ্চ আদালতের এ পর্যন্ত এসে থেমে যাওয়াটা হতাশার। দেশের সংবিধান এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে সূচিত ইতিবাচক পরিবর্তনসমূহের সঙ্গে সংগতি রেখে পুরো বিষয়টি যদি দেখা হতো, তাহলে কতিপয় চেয়ারম্যানের মনগড়া কার্যক্রম শুধু নয়, গ্রাম আদালত আইনের কার্যকারিতাই পুরোপুরি বৈধ থাকার কথা নয়। যেখানে আইনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে সংবিধানের (২২ অনুচ্ছেদ) বিচার বিভাগের পৃথক্করণ নীতি সমুন্নত করা হয়েছে। সেখানে ‘গ্রাম আদালত আইন ২০০৬’-এ দলীয় পরিচয়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ও নেতার ওপর ফৌজদারি ও দেওয়ানি কার্যবিধির বেশ কিছু ধারা-উপধারার অধীনে আদালত বসিয়ে বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্ব বহাল রয়েছে। মাসুদার হোসেন মামলার মতো গ্রাম আদালতের এসব মামলায়ও যুগান্তকারী রায় ঘোষণার অবকাশ রয়েছে। এখানে শুধু কয়েকজন চেয়ারম্যানকে সতর্ক করে দেশের উচ্চ আদালত দায়িত্ব শেষ করতে পারে না।
‘গ্রাম আদালত’ আইনে ‘আদালত’ স্থাপন ও আদালতের বিচারিক কাজ নিম্নলিখিত কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যবস্থায় বিচারকার্য গরিব মানুষের সর্বক্ষেত্রে সহায়ক নয়, বরং পক্ষপাতদুষ্ট ও নিবর্তনমূলক। প্রথমত, সংবিধানের (২২) নির্দেশনা অনুসরণ করা হলে বিচার বিভাগের পৃথক্করণের নীতির আলোকে নির্বাহী বিভাগকে প্রত্যাহার করে হলে কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তির অধীনে আদালত কার্যক্রম পরিচালনা বৈধ হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী এ আদালতের বিচারক হিসেবে যাঁদের নিয়োজিত করা হয়, তাঁদের (ইউপি চেয়ারম্যান, দুজন ইউপি সদস্য এবং অপর দুজন সাধারণ মনোনীত ব্যক্তি—পাঁচজন) কারও বিচারকার্য পরিচালনার উপযোগী শিক্ষাগত পটভূমি, আইন বিষয়ে দক্ষতা, প্রয়োজনীয় আইনবিষয়ক প্রশিক্ষণ, এমনকি নিরপেক্ষতার কোনো শপথ নেই। তৃতীয়ত, এ আদালতের ওপর দেশের উচ্চতর কোনো আদালতের নজরদারি নেই। চতুর্থত, প্রায় ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে এ আদালতের বিচারকদের রায় লেখার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ নেই। পঞ্চমত, এ আদালতের প্রদত্ত রায়ও কার্যকর করার মতো ইউনিয়ন পরিষদের যথাযোগ্য প্রশাসনিক শক্তি ও সামর্থ্য নেই। ষষ্ঠত, এ আদালতের সার্বিক অবস্থা নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের উপযোগী নয়। সপ্তমত, ইউনিয়ন পরিষদে যাঁরা নির্বাচন করেন, তাঁরা ‘বিচারক’ হওয়ার অঙ্গীকারে নির্বাচন করেন না। এসব কারণে ‘গ্রাম আদালত’ আদালত হিসেবে সাংঘাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। গ্রাম আদালতের এ ঘটনা পত্রিকান্তরে যখন আদালতের নজরে আনা হয়, তখন স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল সুদীর্ঘ সময়কাল ধরে গ্রামীণ বিচারব্যবস্থায় যে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, উচ্চ আদালত সে বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ওপর সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা প্রদান করবেন। আশা করি, আদালতের সে সুযোগ এখনো আছে। এখনো উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্থানীয় সরকার, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে এ আইনের ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। তা ছাড়া বিচার বিভাগের পৃথক্করণের আলোকে দেশের গরিব, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগণের জন্য বিচারালয়ের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দিতে পারেন।
গাইবান্ধার সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যে আদালত বসিয়েছিলেন বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়েছিল, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাতে দোষের কিছু দেখিনি। দেশে আইনের শাসন না থাকলে মানুষ আইন নিজের হতে তুলে নেয়। আদালতের সেবা ওই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেভাবে থাকা উচিত ছিল তা না থাকায় যতটুকু সুযোগ ‘গ্রাম আদালত আইন ২০০৬’ সৃষ্টি করে দিয়েছে, তার একটি নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক রূপ ওই চেয়ারম্যান দিয়েছেন। তাতে প্রতি সপ্তাহে ১৫-২০টি গ্রামীণ বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছিল বলেও একই প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। দেশের প্রচলিত মানবাধিকারসহ অনেক আইনে তা সিদ্ধ না হলেও আদালতবিহীন সামাজিক বাস্তবতায় এ জাতীয় ব্যবস্থার উৎপত্তি ও বিকাশ একটি স্বাভাবিক প্রবণতা।

৩.
১৬ কোটি মানুষের এ দেশে শুধু ৬৪টি জেলা শহরে অধস্তন আদালত স্থির হয়ে থাকবে, তা অনন্তকালের জন্য সংগত, শোভন ও প্রত্যাশিত নয়। দেশের বিচারব্যবস্থা ও আদালতকে অন্যান্য প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে সংগতি রেখে আরও সম্প্রসারিত হতে হবে। এ মুহূর্তে ৩০ থেকে ৫০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউনিয়ন পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আদালত কাঠামো সম্প্রসারণ সম্ভব না হলেও অন্তত গড়পড়তা তিন লাখ লোকের বসবাস এলাকা উপজেলা পর্যায়ে আদালত কাঠামো সম্প্রসারণ করা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। ১৯৮০-র দশকে উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও সহকারী জজকোর্ট স্থাপিত হয়। ১৯৯১ সালের পর নির্বাহী আদেশে সে আদালত প্রত্যাহার করে জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো উপজেলায় আইন মন্ত্রণালয়ের সম্পদ হিসেবে আদালত ভবনসমূহ পড়ে আছে। আর অপরদিকে উপজেলা আদালত নামে জেলায় সহকারী জজ আদালত চলছে। অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক আদালতের স্বেচ্ছাচার থেকে নিরীহ মানুষকে রক্ষা, মামলাজট হ্রাস করা, সাধারণের কাছে বিচার সহজলভ্য ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে আনুষ্ঠানিক দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত চালু হওয়া উচিত। উপজেলায় বিচারিক আদালত না থাকায় পুলিশি ব্যবস্থাও অতিমাত্রায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে রাজনীতির অপরাধপ্রবণতার একটা সখ্য গড়ে উঠেছে। তাই ওই পর্যায়ে সার্বিক ভারসাম্যের জন্য উপজেলা পর্যায়ে বিচার বিভাগের সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

 ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
ahmedt_dr@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.