প্রতিবেশীর উষ্ণ পথে ঠাণ্ডা জল by জয়ীতা ভট্টাচার্য

ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি যে অবস্থান নিয়েছেন, তা স্পষ্টতই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত দুই নদী তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর চরম সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিকভাবে আমাদের জাতীয় স্বার্থকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।


সংবিধান অনুসারে নদীর পানি সংক্রান্ত বিষয় রাজ্য সরকারের আওতাধীন। এই বিষয়টিই অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগী নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ করে তুলেছে। আমরা দেখছি, সংবিধানের এই বিধানের সুযোগ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ভাগাভাগী ইস্যুকে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ সুবিধা আদায়ের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন।
মমতার প্রথম টার্গেট ছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের আগ মুহূর্তে তিনি খসড়া চুক্তিটির ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেন। একেবারে শেষ মুহূর্তের বিরোধিতায় স্বাক্ষর না হওয়া ওই চুক্তি দুই দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট বিঘি্নত করেছে।
খুব সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টার্গেট করেছেন ১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিটিকে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেছেন, ফারাক্কা ব্যারাজের দুটি জলকপাটে ফাটল ধরার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার (ইচ্ছাকৃত) গোপন রেখেছিল। ফলে বাংলাদেশ ৮২,৮০১ কিউসেক পানি পেয়ে আসছে। ১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী যেখানে শুকনো মৌসুমে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এসব অভিযোগ বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেসব কথাবার্তাকেই কেবল শক্তিশালী করেছে। আর পানি বণ্টন তো তাদের জন্য বরাবরের পছন্দসই ইস্যু। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেহেতু ভাটি অঞ্চল। উজানের যে কোনো পদক্ষেপই সেখানে কড়া নজরদারিতে থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ করে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকে সে দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান। বাংলাদেশ নিয়মিতই দাবি করে থাকে যে, ওই ব্যারাজ তাদের পরিবেশের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
গঙ্গার পানি ভাগীরথী দিয়ে প্রবাহিত করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে ফারাক্কা ব্যারাজের নির্মাণ কাজ সূচিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে এটি চালু হয়। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এ ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির মধ্য দিয়ে ওই বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ওই সমঝোতা এখন দুই দেশের পানি সংক্রান্ত সহায়তার বেঞ্চমার্কে পরিণত হয়েছে। যদিও চুক্তিটি পর্যালোচনার দাবি বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ই উঠেছে, ঢাকার মসনদে অধিষ্ঠিত কোনো সরকারই এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৈচৈ আন্তর্জাতিক চুক্তিকে শ্রদ্ধা করার ব্যাপারে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতায় একটি প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
অস্বীকার করা যাবে না যে, সীমান্তের উভয় পাশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতায় টান পড়েছে। ফলে প্রত্যেক দেশই চেষ্টা করবে এই ধরনের সম্পদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে। এমন পরিস্থিতিতেই আসলে প্রয়োজন হয় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার। অন্যথায় প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনাই অনিবার্য করে তোলে।
ভারত যখন নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক খুবই জরুরি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের বোঝাপড়া কখনোই খুব স্বস্তিদায়ক ছিল না। বিলম্ব হলেও বাংলাদেশ অবশ্য সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু হায়! পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি সেই উষ্ণ আবহে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিতে বসেছে।

জয়ীতা ভট্টাচার্য :ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো; শুক্রবারের হিন্দুস্তান টাইমস থেকে ভাষান্তর শেখ রোকন

No comments

Powered by Blogger.