প্রতিক্রিয়া-উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন by এম এম শাহ আলম

২২ ফেব্রুয়ারি মিজানুর রহমান খানের ‘উচ্চ আদালত কি প্রজাতন্ত্রের বাইরে?’ শীর্ষক নিবন্ধটি আমার নজরে এসেছে। সেই সুবাদে আমার এই বক্তব্যের অবতারণা। বাংলা ভাষা নিয়ে আমার একটা আবেগ আছে। কিন্তু সেটা কাজ দিচ্ছে না। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের একটা ঘটনা বলি।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে একটি সভা হচ্ছিল, সেখানে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। একজন বললেন, আইন-আদালতের ভাষা ইংরেজি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আমি তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করলাম। বললাম, বাংলাতেই হতে হবে আইন শিক্ষা। তবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি আমাদের জানতে হবে। জাপান, কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর—সব দেশ নিজেদের ভাষায় আদালত চালাচ্ছে। তারা পারলে আমরা পারব না কেন? তারাও তো মাতৃভাষার পাশাপাশি একই সঙ্গে ইংরেজিতেও পারদর্শী।
হংকংয়ে ১৯৯২ সালে এক সেমিনারে আমি অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে আমি বলেছিলাম, মাতৃভাষায় আইন শিক্ষা ও আদালত চালানোই উত্তম। সেখানে নানা দেশের অনেক কৃতী আইনবিদ ছিলেন। কমনওয়েলথ দেশগুলোর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। ভারতের আইনের জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি অধ্যাপক এন. আর. মাধবা মেনন, ড. উপেন্দ্র বকশি প্রমুখ আমার বক্তব্যের প্রশংসা করলেন। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। আমি ভীত ছিলাম, আমার বক্তব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কি না। কিন্তু আমি মুগ্ধ হলাম প্রায় সবাই তাঁদের বক্তৃতায় আমার বক্তব্য সমর্থন করলেন। আমি সেখানে এও বলেছিলাম, কমনওয়েলথ দেশগুলোর আদালতের ভাষা ও আইন শিক্ষা চলবে মাতৃভাষায়। তবে ফরাসি বা জাপানি নয়, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি রাখতেই হবে।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে যোগদানের পর আইনের স্নাতক পর্যায়ে ইংরেজিতে ১০০ নম্বরের একটি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলাম। এখন সেটা ২০০ নম্বর হয়েছে।
১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি যদি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে আদালতে এভাবে ইংরেজি থাকার কথা নয়। অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আমাদের সংসদে বক্তৃতা-বিতর্ক বাংলায় হচ্ছে। আইনও বাংলায় তৈরি হচ্ছে। কিন্তু শুধু উচ্চ আদালতে তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। অধস্তন আদালতে অবশ্য বাংলার কিছুটা প্রচলন রয়েছে। উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় বিরল, হয় না বললেও চলে। অথচ ১৯৮৭ সালের আইনে আদালতের ভাষা বাংলা হিসেবেই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্ট আদালতের বাইরে কি না। সংবিধান বলে দিয়েছে আদালত বলতে সুপ্রিম কোর্টও বোঝাবে। এখন আইন বলে দিয়েছে, আদালতের ভাষা হবে বাংলা।
আমরা আইন কমিশন থেকে ২০১১ সালে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাই। মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, যিনি সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন, তিনি আইন কমিশনের অবৈতনিক সদস্যও। গত বছর এ বিষয়ে তিনিই এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন, সুপারিশের খসড়া তৈরি করেছিলেন। আমি তাঁকে সমর্থন দিই।
হাশমতউল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ বলেছিলেন, দেওয়ানি কার্যবিধি বা সিপিসিতে একটি ধারা আছে, যার কারণে আদালতে ইংরেজি চলতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশে আদালতের কাজ যখন শুরু হলো তখন তা ইংরেজিতে ছিল। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারায় বলা আছে, ‘আদালতের ভাষা নির্ধারণের ক্ষমতা: এই বিধির উদ্দেশ্যে এর দ্বারা শাসিত অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিটি আদালতের ভাষা কী হবে সরকার তা নির্ধারণ করতে পারবে।’ কিন্তু এর আওতায় গত ৪০ বছরে কোনো পরিপত্র বা ঘোষণাপত্র জরি করা হয়েছে বলে জানা যায় না। ১৯০৮ সালের সিপিসির ১৩৭ ধারার এক উপধারায় বলা আছে, ‘এই কার্যবিধি আরম্ভ হওয়ার দিনে এর যে ভাষা ছিল, সেটাই হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন যেকোনো আদালতের ভাষা হিসেবে গণ্য হবে। যতক্ষণ না সরকার অন্যরূপ কোনো ঘোষণা দেন।’ এর দুই উপদফায় বলা আছে, ‘সরকার এ ধরনের আদালতের ভাষা কী হবে তা ঘোষণা করতে পারেন। এবং এসব আদালতের কার্যধারা কী ভাষায় লিখিত হবে তাও বলে দিতে পারে।’
আর গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি আমরা আমাদের ১০৭ নম্বর রিপোর্টে বলেছি, ‘বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে তিন অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানের এ বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না বলে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ জারি করা হয়। সংবিধান ও ওই আইনের অধীন আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সব কার্যক্রম ও রাষ্ট্রীয় নথিপত্র বাংলা ভাষায়ই সম্পাদিত হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আইন বিভাগ তথা জাতীয় সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদের বিধান এবং ১৯৮৭ সালের দুই নম্বর আইনের বিধান পুরোপুরি অনুসরণ করছে। নিম্ন আদালতের তা অনুসরণ করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হাশমতউল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছেন যে সরকার অধস্তন দেওয়ানি আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১২৭ (২) ধারায় কেনো ঘোষণা দেয়নি বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্ত্বেও অধস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে। ফলে আজ অবধি বিচারকাজে বাংলাভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি।’
আমরা আমাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছি যে সরকার আদালতের ভাষা বাংলা মর্মে ফৌজদারি কার্যবিধি ও সিপিসির উল্লিখিত দুটি ধারার অধীন মোট দুটি ঘোষণাপত্র জারি করতে পারে।
বিচার কাজে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এর প্রয়োগ বিষয়ে আমাদের আরও অভিমত ছিল, ‘প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র দুটি জারি করা হলে আদালতে তা অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব। ইংরেজিতে রচিত বিদ্যমান আইনসমূহ বাংলায় অনুবাদ ত্বরান্বিত করা জরুরি। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়সমূহের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুবাদ কাজ বেগবান করা এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল ও উদ্যোগী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। বর্তমান বছরের (২০১১) একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই উল্লিখিত ঘোষণাপত্র দুটি জারি এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আইন কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ করছে। এ বছর মহান একুশে পালনের এটি হবে একটি প্রকৃষ্ট উপায়।’
এখন প্রশ্ন হলো, আইন মন্ত্রণালয় আইন তৈরি ও তাতে সংশোধনী আনাসহ সকল কার্যক্রমে বাংলা বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করছে। তাহলে আদালত তার বাইরে থাকবে কেন? হাশমতউল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি মামলাকে পুঁজি করে ইংরেজিওয়ালারা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
মিজানুর রহমান খান তাঁর নিবন্ধে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বিধির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রেও আইন কমিশন কিন্তু তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছে। ১৯ জানুয়ারি ২০১১-এর ওপর মতামত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে আমরা চিঠি পেয়েছিলাম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ আমরা বলেছি, ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু এর একটি বাংলা পাঠও কাঙ্ক্ষিত।
আমাদের অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মাননীয় বিচারকেরা ইচ্ছে করলেই পুরোপুরি বাংলা ভাষায় সওয়াল-জবাব এবং রায় লিখতে পারেন। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁদের একটি প্রভাবশালী অংশ এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য ইংরেজি আঁকড়ে আছেন বলে প্রতীয়মান হয়। আরেকটি যুক্তি দেওয়া হয় তাঁরা আদালতে ইংল্যান্ড ও ভারতের মতো দেশের উচ্চ আদালতের রায়ের উদ্ধৃতি দেন। সেগুলো ইংরেজিতে লেখা। আমি মনে করি, এটা খোঁড়া যুক্তি। কারণ, তাঁরা চাইলেই সেগুলো বাংলায় তরজমা করতে পারেন। আমি এই যুক্তির সঙ্গে একমত যে বাংলাদেশ সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসংগতি কিংবা সংঘাতপূর্ণ হতে পারে এমন কোনো রায়, আদেশ, আইন কিংবা বিধি-বিধানের ঠাঁই এই প্রজাতন্ত্রে হওয়ার কথা নয়।
ড. শাহ আলম: ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, আইন কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.