তাঁরা আইন অগ্রাহ্য করতে পারেন না-মন্ত্রী ও সাংসদদের আয়কর

গত জুনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন ঘোষণা দেন যে মন্ত্রী ও সাংসদেরা আর বৈষম্যমূলক সুবিধার বোঝা বইতে পারছেন না, তখন জনগণ নিশ্চয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। হয়তো তাতে কিছুটা মধুর বিস্ময়ও ছিল। সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার মধ্যে এটা ছিল একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।


অর্থমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, ‘জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার হিসেবে সবার ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রযোজ্য হওয়ার গুরুত্ব থেকেই করমুক্ত থাকার সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হলো।’ সাংসদেরা কিন্তু বিরোধিতা ছাড়াই তা পাস করে দিলেন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বহুকাল থেকেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। হাউস অব কমন্সের সদস্যরা ব্রিটেনের অন্য চাকরিজীবীদের মতো সমহারে তাঁদের কর ও বিমা পরিশোধ করে থাকেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নীতিনির্ধারকেরা আমাদের হতাশ করলেন। তবে এ জন্য এনবিআরের যেসব কর্মকর্তার ওপর বিষয়টির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার দায়িত্ব ছিল, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা যেতে পারে। সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বহু বিষয়ে সরকারের নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমলাতন্ত্রের যাঁতাকলে পড়ে। আমলাতন্ত্র কতটা উদাসীন ও অদক্ষ হতে পারে, তার একটা চোখে আঙুল দেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত এই ঘটনা।
আয়কর জমা দেওয়ার শেষ মুহূর্তে এনবিআর নির্বিঘ্নে জানিয়ে দিতে পারল যে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও মন্ত্রীদের আয়কর দিতে হবে না। প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ে অবশ্য আমরা এটা বুঝতে পারি না যে যথাসময়ে আইন ও বিধিবিধান সংশোধনের উদ্যোগ আদৌ নেওয়া হয়েছিল কি না। এটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বিষয় এমন হেলাফেলা ও চুপিসারে উপেক্ষা করার মনমানসিকতা নিন্দনীয়। কী কারণে সংসদকে উপেক্ষা করতে হলো, তার একটা উপযুক্ত ব্যাখ্যা দাবি করছি।
মন্ত্রী ও সাংসদদের কর না দেওয়ার কারণে সরকারি কোষাগার কত টাকা থেকে বঞ্চিত হলো, তা জানার অধিকারও জনগণের আছে। সরকারের উচিত হবে একটি গ্রহণযোগ্য সত্য বক্তব্য জনগণের সামনে প্রকাশ করা। কারণ এ বিষয়টির সঙ্গে এই হতভাগ্য রাষ্ট্রের দুটি স্তম্ভের সততা ও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। বিষয়টি আমলাতান্ত্রিক ব্যর্থতা হলে সে জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই তিরস্কার করতে হবে। আমরা জেনেছি, সংসদ সচিবালয় বিষয়টি এনবিআরের কাছ থেকে সবেমাত্র জেনে সাংসদদের অবহিত করেছে। তবে শুধু এতটুকুর মধ্যেই সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্ব চুকেবুকে যাবে না। আমরা আশা করব, অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি এই বিস্ময়কর ঘটনার সাংবিধানিক ও বাস্তব অবস্থা খতিয়ে দেখবে।
ইউরোপের ধনী ব্যক্তিরা যখন অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় তাঁদের ওপর বাড়তি কর চাপানোর অনুরোধ করছেন, তখন আমাদের মন্ত্রী-সাংসদ, যাঁরা মূলত এ সমাজের ধনিক গোষ্ঠী এবং যাঁরা ভোটারদের করভ্যাস বাড়ানোর শপথ নিয়েছেন, তাঁরা ‘কর ফাঁকি’ দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এটি জাতির জন্য কোনোভাবেই গৌরবের নয়।
দেশের সাধারণ নাগরিকেরা যদি তাঁদের আয়ের জন্য রাষ্ট্রকে কর দিতে পারেন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী-সাংসদেরা কেন দেবেন না? জাতীয় সংসদে অনুমোদিত বাজেট বা আইন অগ্রাহ্য করার অধিকার কারও নেই।

No comments

Powered by Blogger.