পিলখানা হত্যাকাণ্ড-সংকট ব্যবস্থাপনার জন্য যথার্থ শিক্ষা কি নেওয়া হয়েছে? by ইমতিয়াজ আহমেদ

'বিডিআর বিদ্রোহ' এক বিয়োগান্ত অধ্যায়। এ থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। আমরা যদি মনে করি, ২০০৯ সালেই শেষ ঘটনাটি ঘটে গেছে, তাহলে নিজেদের ধোঁকা দেওয়া হবে। আর যেন এমন আকস্মিক বিপদের মুখোমুখি না হই সেটা নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে জরুরি কাজ। যদি তার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দক্ষতা


মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এ ধরনের আরেকটি বিপর্যয় ঘটতে চলেছিল বলে সরকার থেকেই বলা হচ্ছে। আশা করব আমাদের সরকার, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ইত্যাদি নানা পর্যায় থেকে এ ধরনের বিপদ মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হবে


২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বুকে পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবি) সদর দফতরে জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। 'পিলখানা ট্র্যাজেডি' কেড়ে নেয় ৫৭ জন সেনা অফিসারের প্রাণ। তারা যে বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতেন, যাদের কমান্ড দিতেন তাদের হাতেই নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। সাধারণত বিদ্রোহ কিংবা এ ধরনের ঘটনায় মৃতদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু বিডিআরের 'বিদ্রোহী জওয়ানরা' লাশের অবমাননা করেছে। ম্যানহোল-ড্রেনে লাশ নিক্ষেপ করেছে কিংবা গণকবর দিয়েছে। এমনকি অফিসারদের পরিবারের নারী সদস্যদেরও নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। এ সময়ে বিদ্রোহীরা জনমত বিভ্রান্ত করার জন্য গণমাধ্যমকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছিল।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভী রহমানসহ দলের অন্তত ২৪ জন নেতাকর্মী। সে সময়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা ভয়াবহ এ হামলায় আহত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু'জনেই এ ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তৃতীয় আরেকটি গুরুতর ঘটনা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার অন্তত পাঁচশ' স্থানে একযোগে বোমা হামলা। এ ঘটনার পেছনে ইসলামী জঙ্গি শক্তি সক্রিয় ছিল। পরের কয়েকটি মাস তারা ঝালকাঠি, নেত্রকোনা, গাজীপুরসহ কয়েকটি স্থানে আত্মঘাতী বোমা-গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে হতাহতের অনেক ঘটনা ঘটে। জঙ্গিরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে সক্রিয় এবং যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে বলে অনেকের মনে হয়। কর্মস্থলে, রাজপথে বা জনবহুল স্থানে এমনকি বাড়িতেও কেউ নিরাপদ কি-না, এ প্রশ্ন ব্যাপকভাবেই দেখা দেয়।
চলতি বছরের প্রথম দিকে সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশ রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। তাদের পরিকল্পনা সফল হলে 'অন্ধকার সময়' নেমে আসার শঙ্কা ছিল, এমন মত রয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিয়মিত যা ঘটছে, সেটাও কিন্তু ঘরে-বাইরে এক ধরনের সংকট তৈরি করছে। ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে নিরীহ বাংলাদেশিদের প্রাণ যাচ্ছে নিয়মিতভাবে। লাঞ্ছনা-অপমানের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। এমনকি ভারতের মানবাধিকার সংগঠন এবং গণমাধ্যমেও এর তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিএসএফের আচরণে জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ এবং বিষয়টিকে সরকারের পররাষ্ট্রনীতির শোচনীয় ব্যর্থতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ভারতীয় এ বাহিনীর মুখোমুখি থাকে আমাদের সীমান্তরক্ষীরা_ সে সময়ের বিডিআর এবং এখনের বিজিবি। কিন্তু এ বাহিনীই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল।
দেশে এবং বিদেশে অনেক বিদ্রোহের ইতিহাস আমাদের জানা আছে। কিন্তু পিলখানায় নিষ্ঠুরতার যে প্রকাশ ঘটেছিল, সচরাচর সেটা দেখা যায় না। '২৫ ফেব্রুয়ারি কালসকাল' কেন ও কীভাবে ঘটতে পারল তার মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণও প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সকালের দিকেই দরবার হলের ভেতরে ও বাইরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরে আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। কিন্তু দেশবাসী তো বটেই এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও প্রকৃত কী ঘটেছে সে বিষয়ে কোনো সঠিক চিত্র ছিল না। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও সেলফোনের যুগে এটা অভাবিত। তথ্যে কেন এমন ঘাটতি ছিল, সেটা নিয়ে শুধু সরকার নয় সংশ্লিষ্ট সব মহলকে ভাবতে হবে। যারা এমন নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত, তাদেরই কয়েকজন কয়েক ঘণ্টা পর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে তার সঙ্গেই বৈঠক করে 'সাধারণ ক্ষমার' আশ্বাস আদায় করে নিল, অথচ তখনও প্রকৃত ঘটনা অজানা।
যারা প্রধানমন্ত্রীর সামনে এদের হাজির করার পরামর্শ দিয়েছিল তাদের সতর্কতায় মারাত্মক ঘাটতি ছিল তাতে সন্দেহ নেই। গোয়েন্দা ব্যর্থতার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের ব্যর্থতাও ছিল। এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন বলা যায়। ভারতের মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলসহ কয়েকটি স্থানে সন্ত্রাসী হামলার পর একদিকে সামরিক অভিযান চলেছে, অন্যদিকে নানা পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে সামনে আসতে হয়নি। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চেইন অব কমান্ড থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসের করুণতম অধ্যায় যখন সংঘটিত হয়েছে, তখন এর ব্যত্যয় ঘটেছে। কিন্তু তা থেকে তিন বছরেও কার্যকর কোনো শিক্ষা আমরা নিতে পারিনি।
এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার দারুণ অভাব বাংলাদেশে_ এ বিষয়ে দ্বিমত কম। পরিস্থিতি কোন উপায়ে মোকাবেলা করা হবে, কাজের সমন্বয় কীভাবে হবে, কে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবে_ এসব বিষয় অজানা। এর ফলে গুজব ডালপালা মেলে, আতঙ্ক ছড়ায়। স্বার্থান্বেষী মহল তৎপর হয়ে ওঠে।
কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর এক সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছেন। অতীতেও এ ধরনের কাঠামো গঠনের প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু তা বেশি দূর এগোয়নি। বাংলাদেশের দীর্ঘ সামরিক শাসনের ক্লেদাক্ত ইতিহাস এ বিষয়ে শঙ্কা ও অনীহার বড় কারণ। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব এলেই সাধারণভাবে ধারণা হয় যে এতে সশস্ত্র বাহিনীর আধিপত্য থাকবে এবং তারা নিরাপত্তার বাইরেও রাজনীতিতে নাক গলাবে। আশির দশকের শুরুর দিকে সেনাবাহিনী প্রধান এইচএম এরশাদ এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিলেনও।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য শঙ্কা যে কোনো সময়েই সৃষ্টি হতে পারে এবং তা মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক পরিবেশেও বিশেষ ব্যবস্থা থাকা চাই। এ ধরনের কাঠামো বেসামরিক সরকারের অধীনেই কাজ করবে। তাদের কাজের পরিধি নির্ধারণ করে দেবে সরকার। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সরকার এ প্রতিষ্ঠানকে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করলে, তবে মূল উদ্দেশ্য বিঘি্নত হবেই। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাতে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও সদস্য হিসেবে রয়েছেন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী। জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যানকে এ কমিটির প্রধান উপদেষ্টা রাখা হয়েছে।
ভারতে এ ধরনের কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও থাকেন স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী, তিন বাহিনী প্রধান এবং বিএসএফের মহাপরিচালককেও রাখা হয় সদস্য হিসেবে। 'র' এ প্রতিষ্ঠানকে টেকনিক্যাল সমর্থন জোগায়। এদের নিজস্ব স্টাফ রয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ডেপুটেশনেও কর্মী নেওয়া হয়। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা, থিঙ্কট্যাঙ্ক, এনজিও এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। তারা কাজ করে পুরোপুরি বেসামরিক সরকারের অধীনে। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি কাঠামোতে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠিত হলে এ বিষয়টিতে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস রয়েছে তা দূর হতে পারে। এটা কার্যত সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান_ এমন ধারণাও আর সৃষ্টি হতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাকেও কমিটির সদস্য করা যায়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে 'বিরোধী দল দমনের আরেকটি সরকারি হাতিয়ার' হিসেবে চিহ্নিত করার অবকাশ থাকবে না। জাতীয় সংকটের সময়ে এ ধরনের কমিটি কাজ করলে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে_ এমন বার্তা যাবে সব মহলে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড তিন বছরের আগে ঘটেছে। বিচার কাজ শুরু হয়েছে একাধিক অভিযোগে এবং কয়েকটি আদালতে তা চলছে। প্রকাশ্যে এত বড় বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পরও বিচার কাজ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে না, এমন অভিযোগ রয়েছে এবং তার দায় সরকারের ওপরে পড়ছে। জনগণ মনে করছে, গোটা বিষয়টিতে তাদের অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। ন্যায়বিচার প্রশ্নে অনেকের রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। এ থেকে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে বলেও কারও কারও শঙ্কা রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল থাকলে তারাই গোটা বিষয়টি তদারক করতে পারত।
২০০৭-০৮ সাল বাদ দিলে বাংলাদেশে একটানা দুই যুগ গণতান্ত্রিক শাসন চলছে। বলা যায়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেকটা পরিণত রূপ পাচ্ছে। এ অবস্থায় সংকট ব্যবস্থাপনার বিশেষ আয়োজনের তাগিদ সঙ্গত বলেই মনে করি। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল নাম নিয়ে আপত্তি থাকলে ভিন্ন কোনো নামেও কাজ শুরু করা যায়। তারা যেমন নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকবে, তেমনি সংশ্লিষ্ট সবার জন্য আধুনিক তথ্য-উপাত্ত নিশ্চিত করবে। নিরাপত্তার প্রতি হুমকি এখন কেবল জানা পথে আসে না। প্রতিদিন নতুন নতুন ফ্রন্ট উন্মুক্ত হচ্ছে। দক্ষ লোকবল নিয়ে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠান দেশ-বিদেশের একাধিক গবেষণা সংস্থার কাছ থেকেও সহায়তা নিতে পারে। তাদের মিডিয়া সেল থাকবে এবং সেখানেও দক্ষতার সমাবেশ চাই।
'বিডিআর বিদ্রোহ' এক বিয়োগান্ত অধ্যায়। এ থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। আমরা যদি মনে করি, ২০০৯ সালেই শেষ ঘটনাটি ঘটে গেছে, তাহলে নিজেদের ধোঁকা দেওয়া হবে। আর যেন এমন আকস্মিক বিপদের মুখোমুখি না হই সেটা নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে জরুরি কাজ। যদি তার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দক্ষতা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এ ধরনের আরেকটি বিপর্যয় ঘটতে চলেছিল বলে সরকার থেকেই বলা হচ্ছে। আশা করব আমাদের সরকার, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ইত্যাদি নানা পর্যায় থেকে এ ধরনের বিপদ মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হবে। এ আলোচনা হতে হবে খোলামেলা এবং দলীয় দৃষ্টিকোণ যেন অযথা করণীয় নির্ধারণে সমস্যা সৃষ্টি না করে।

ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.