প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নেই! by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

গত ৯ জুন সংসদে উত্থাপিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট বক্তৃতার ৪৯ থেকে ৫৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। বক্তৃতার ১১৮ থেকে ১৩৪ অনুচ্ছেদে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আগামী অর্থবছরে সরকার কী করতে যাচ্ছে তা বিবৃত হয়েছে। এখানেও দুটি শিরোনামে শিক্ষাব্যবস্থার দুটি পর্বকে ভাগ করা হয়েছে।


প্রথম শিরোনামটি হচ্ছে, 'সামগ্রিক শিক্ষা খাত'। এটি ১১৮ থেকে ১২৮ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগটি 'প্রাথমিক ও গণশিক্ষা' নামে স্থান পেয়েছে ১২৯ থেকে ১৩৪ অনুচ্ছেদে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক গণশিক্ষার সামগ্রিক বিবরণ এসব (১১৮-১৩৪) অনুচ্ছেদে স্থান পেয়েছে। 'সামগ্রিক শিক্ষা খাতে' যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়েছে তা হচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ফাউন্ডেশন, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষার গুণগত মান, সৃজনশীল প্রতিভা অন্বেষণ, এমপিওভুক্তকরণ, উচ্চশিক্ষার বৈষম্য দূর, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল।
'প্রাথমিক ও গণশিক্ষা' পর্বে স্থান পেয়েছে যথাক্রমে শিশুকে স্কুলমুখী করার সর্বাত্মক প্রয়াস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমিয়ে আনা, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, নতুন বিদ্যালয় নির্মাণ, পঞ্চম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অধিকতর শিক্ষা, ছাত্রছাত্রীমুখী ও প্রযুক্তিমুখী করার ইচ্ছা এর প্রতিটি অনুচ্ছেদে ব্যক্ত করা হয়েছে_এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের উদ্যোগ ও আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তবে যেটা আমাকে কিছুটা বিস্মিত করেছে তা হলো, বর্তমান মহাজোট সরকারের একটি বিশাল কৃতিত্ব হচ্ছে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। সরকার ২০১০ সালে মহান জাতীয় সংসদে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছে। সংসদে এটি গৃহীত হওয়ার পর এর বাস্তবায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করতে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া দেশকে একটি আধুনিক শিক্ষানীতিতে এগিয়ে নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই দেখিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন দেশের জন্য প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠনও করেছিলেন। একটি অগ্রসর শিক্ষানীতি প্রণয়নও করা হয়েছিল, কিন্তু পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞের পর আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতির সঙ্গে শিক্ষানীতিও পরিত্যাজ্য হয়েছিল।
শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হওয়ার পর এটিই হচ্ছে প্রথম বাজেট, যেখানে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা বিশেষভাবে স্থান পাওয়ার কথা। উলি্লখিত অনুচ্ছেদগুলোতে কেন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কোনো পরিকল্পনা ও রূপকল্প অর্থমন্ত্রী মহোদয় উল্লেখ করলেন না_তা আমার মতো অনেকের কাছেই বোধগম্য হলো না। বর্তমান সরকারের মেয়াদের অর্ধেক সময় এরই মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে। এখনই যদি এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত না হয় তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলে শিক্ষানীতির ভাগ্যে কী ঘটবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়।
বাজেট দলিলে শিক্ষা খাত নিয়ে কাঠামোগত বিন্যাসের চেয়েও দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শনে যেসব পরিবর্তন হচ্ছে, তা অনেকটাই অনালোচিত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। যে কারণে পরিবর্তনের ধারা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তেমন বিশেষ কিছু জানতে পারে না। বর্তমান বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী 'সামগ্রিক শিক্ষা খাত' এবং 'প্রাথমিক ও গণশিক্ষা' পর্বে যেসব বিষয় উপস্থাপন করেছেন তাতে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সঙ্গে বর্তমান সরকারের মৌলিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য অবশ্যই প্রতিফলিত হয়েছে। নিবন্ধের শুরুতেই অনুচ্ছেদগুলোর যেসব উপ-শিরোনাম উল্লেখ করা হয়েছে তাতেই স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে শিক্ষার আওতায় আনতে অঙ্গীকারবদ্ধ। একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, অবহেলিত শিশু, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ সবাইকে শিক্ষাঙ্গনে আনতে সচেষ্ট। এ জন্য বেশ কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে, ২০১১-১২ অর্থবছরেও নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ সবই প্রণিধানযোগ্য বিষয়। কিন্তু এ বিষয়গুলো তো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অধ্যায় ২-এ চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। অন্যান্য অধ্যায়েও যেসব শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেগুলোকে অর্থমন্ত্রীর ভাষণের অনুচ্ছেদগুলোতে খোঁজাখুঁজি করলে অন্যভাবে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যভাবে উপস্থাপিত হওয়ার অর্থ দাঁড়ায় শিক্ষা খাতে কাজগুলো হচ্ছে, হবে আগের মতোই, কোনো জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মতো নয়। এখানেই আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়টি ঘুরপাক
খাওয়ার কারণ।
বাজেট দলিলে যেসব খাতে দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা-ই বলে দেয় বর্তমান সরকারের শিক্ষা দর্শনের ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্যকে। এতে শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারের নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে। শিক্ষার বরাদ্দেও এর প্রমাণ মেলে। এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে শিক্ষার অংশ ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এটি হচ্ছে মোট ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে তা ছিল ১৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। এ বছরের মোট বরাদ্দ থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পাবে আট হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, সাধারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাবে ১০ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। উভয় মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দের সিংহভাগই ব্যয়িত হবে অনুন্নয়ন বাবদ, অর্থাৎ বেতন-ভাতা, বৃত্তি-উপবৃত্তি ইত্যাদি উপখাতে। উন্নয়ন খাতে ব্যয়িত হবে মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশের বেশি।
গত দুই বছরে বিদ্যালয়গুলো বেশ কিছু সুবিধা সরকার থেকে লাভ করেছে। আগামী অর্থবছরে তা আরো সম্প্রসারিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ফাউন্ডেশনে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনার উদ্যোগ বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে সন্দেহ নেই। তবে শতভাগ শিক্ষার্থীকে (৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ) স্কুলে এ বছর আনা গেলেও ধরে রাখার বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার আর্থিক বোঝা বহন করার যৌক্তিকতাই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে ফল কী হতে পারে তা সহজেই বোধগম্য। এসব অনিয়ম ও অপচয়ের অবস্থান থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দিন দিন এটি আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। অথচ দেশের মানুষকে দক্ষতা অর্জন ও মানবসম্পদে পরিণত হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে_যা বাংলাদেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভয়ানক এক মৌলিক দুর্বলতা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষার বহুমুখী মাধ্যম, দূরশিক্ষণ পদ্ধতি, তথ্যপ্রযুক্তি, ই-লার্নিং ইত্যাদিকে যথাযথ ব্যবহার করা ছাড়া কোনো সহজ পথ খোলা নেই বাংলাদেশের সামনে। প্রথাগত প্রতিষ্ঠান দিয়ে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হওয়ার নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা-পদ্ধতির বৃত্ত ভেঙে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা ঘুরেফিরে একই বৃত্তে অবস্থান করছি। বৃত্ত ভাঙার পথ দেখিয়েছিল জাতীয় শিক্ষানীতি। সেটিকে উপেক্ষা করার পরিণতি সবারই বোধগম্য হওয়া উচিত।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
patwari54@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.