মূল রচনা: একুশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি-নতুন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে by জাহীদ রেজা নূর

প্রথম আলোর আমন্ত্রণে ছয় ভাষাসংগ্রামী গিয়েছিলেন শহীদ মিনারে, তারপর প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে কথা বলেছেন একুশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে। সেই আলোচনাই তুলে ধরা হলো এখানে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করেই মেঘলা হয়ে গেল ১৬ ফেব্রুয়ারির আকাশ। একটু স্বস্তি এল মনে। আমাদের সঙ্গে ছয়জন ভাষাসংগ্রামী।


রোদের ধকল তাহলে আর পোহাতে হবে না। প্রথম আলো থেকে দুটি গাড়িতে শহীদ মিনারে যাওয়া হলো। সেখানে বসে স্মৃতিচারণা করলেন তাঁরা। তারপর ফিরলেন প্রথম আলো কার্যালয়েই। সেখানে এসে একটু বিশ্রামের পর আরেক দফা আলোচনা। এবারের বিষয় একুশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি।
আবদুল মতিন কিন্তু তখনো মনে মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহীদ মিনারে। বললেন, ‘আমরা যখন শহীদ মিনারে গেলাম, দেখলাম সেখানে মানুষ নাই, মানে আমরা বিচ্ছিন্ন কয়েকজন মানুষ। এরপর দেখলাম, কয়েকটি মেয়ে সমবেত হয়েছে। একটু পর উৎসুক মানুষের ভিড় হলো। আমাদের কথা শুনছিল তারা। একসময় তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলো। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না হলে কোনো কিছুই সফল হয় না। ভাষা আন্দোলনেও ছিল জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। ভাষা মানুষের নিজস্ব। এটার জন্য মানুষের স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ থাকবে। আমরা সে আকর্ষণকে কাজে লাগাতে পেরেছিলাম এবং একটা ভাষা আন্দোলন করতে পেরেছিলাম, এইটার ফলেই সমস্ত পাকিস্তানের ভিত নড়ে গেল। এই স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি।’
মুর্তজা বশীর বললেন, ‘আমি কিন্তু খুব আশাবাদী নই। নতুন প্রজন্মকে যখন দেখি, হতাশায় ভুগি। আমিও তো এককালে তাদের মতো ছিলাম। আমার মধ্যে যে সমাজ সচেতনতা ছিল, যে দায়বদ্ধতা ছিল, আজ দেখি, এই প্রজন্মের মধ্যে সেটা নেই। এ জন্য এই প্রজন্মকে দোষারোপ করতে চাই না। এ জন্য দোষী হলেন তাঁরাই, যাঁরা এ দেশের জনগণের কল্যাণের কথা বলে শাসনক্ষমতায় আসেন।
‘ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই, আবার মার্চ বা ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই, তারপর কিন্তু ওটা থাকে না। তার কারণ হলো, যাঁরা ভাষা আন্দোলন করেছেন কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছেন, তাঁদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা প্রয়োজন ছিল সেটি এ দেশের যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা করেননি। এর ফসল রাজনীতিবিদেরা নিয়েছেন। এঁদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চাননি এ জন্য যে তাহলে সর্বসাধারণ জেনে যাবে, এই ভাষা আন্দোলন তো শুধু ভাষার জন্য হয়নি, এটা ছিল সংস্কৃতির ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে, ছিল আর্থসামাজিক মুক্তির লড়াই।
‘তবে আমার বিশ্বাস, নদীর যেমন গতিপথ বেঁধে দেওয়া যায় না, বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে দেখা গেছে, আন্দোলনের ভেতর থেকেই নেতা তৈরি হয়, পথ দেখায়। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, একদিন এই বাংলাদেশের যে নতুন প্রজন্ম, যারা ফাস্টফুডে অভ্যস্ত, ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি সর্বক্ষণ যাদের ব্যস্ত রেখেছে, তারা তাদের সঠিক অস্তিত্ব খুঁজে পাবে এবং আমাদের দেশের যে সমাজ ও সংস্কৃতি হাজার বছরের বলা হয়, সেটার প্রতি আগ্রহী হবে।’
হালিমা খাতুনের কণ্ঠেও হতাশা, ‘একুশ আমাদের সম্পদ। একুশের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। আমরা পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা পেয়েছি, বাংলা একাডেমী পেয়েছি, শহীদ মিনার পেয়েছি। তারপর একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আর বাংলার উন্নয়ন, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, সারা বিশ্বে যে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি, সেখান থেকেও আমরা অনেক কিছু পাচ্ছি। সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে। অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু সবকিছু পেয়েও মনে হয়, আমরা কিছু পাইনি। যাঁরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন, তাঁরা সব মানুষকে বঞ্চিত করে নিজেরাই সবকিছু সঞ্চিত করছেন এবং সঞ্চিত করছেন অন্যায়ের পাহাড়। এই পাহাড় ধ্বংস করতে না পারলে এই সম্পদ, একুশের যে চেতনা-প্রেরণা-প্রাপ্তি, তা ধরে রাখতে পারব না, পারছি না। জানি, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার থাকে। আবার সেই অন্ধকারই আলোতে রূপান্তরিত হয়। পৃথিবীতে সবই চলমান। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, “এ কেমন বাংলাদেশ উত্থান রহিত”। বাংলাদেশে একটা শিল্প খুবই উন্নত, সেটা হলো কথাশিল্প। অন্য সবদিকেই কেবল ফাঁকি। সবকিছুরই একটা পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনের ফলে আবার আমরা একুশের সম্পদ ফিরে পাব।’
ডা. সাঈদ হায়দারকে নৈরাশ্য গ্রাস করেনি। তিনি বললেন, ‘আমি একজন ডাক্তার। আমার বয়স এখন ৮৭ বছর। আমি মনে করি, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই উত্থান-পতন আছে। ওই যে মুর্তজা বশীর বললেন, নদীর গতিপথ বদল হয়, তার মানে, সুড়ঙ্গের শেষে তিনি একটু আলো তো দেখছেন। মতিন ভাই, আহমদ রফিক, আপনারা বলেন তো, ৬০ বছর আগে কোনো ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে কোনো বাংলা শব্দ লিখত? বোধ হয় ‘না’। কিন্তু এখন ওষুধের নামটা হয়তো ইংরেজিতে লেখে। কারণ ভুল-শুদ্ধর একটা ব্যাপার আছে, কিন্তু সম্পর্ক তো রোগীর সঙ্গে। রোগীর ব্যারামে সে কী ওষুধ খাবে, কী পথ্য খাবে, সত্তর থেকে আশি শতাংশ ডাক্তার বাংলায় লেখে।
‘স্বাধীনতা অর্জনের পরপর বাংলা একাডেমীর পাঠ্য বিভাগ থেকে বিজ্ঞানের বিষয় যেন আমরা পাঠ করতে পারি, সেটা নিশ্চিত করতে কিছু বই বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন একাডেমীর পরিচালক আবদুল হকের উদ্যোগে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞান আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত যেভাবে পড়া যায়, সেভাবে বই লেখা আরম্ভ করি। ডেভিডসনের মেডিসিন সম্পূর্ণভাবে অনুবাদ করা হয়। ভাষাসংগ্রামী আবদুস সালাম যখন মেডিকেল ফ্যাকাল্টির ডিন ছিল, তাকে বলেছিলাম, ভাই, তুমি অন্তত এমন করো, যেন প্রশ্নপত্র ইংরেজি এবং বাংলায় হয়। যার যে ভাষায় ইচ্ছা উত্তর দিতে পারবে। সেটাও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি। তবুও আমি আশাবাদী। আমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি, এ সংগ্রামে তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
সুফিয়া আহমেদ যোগ করলেন, ‘বিবেকের তাড়নায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম।
‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা। এখন শিক্ষার যে মান, তাতে শিক্ষার্থীদের খুব খারাপ অবস্থা। আগে বিষয়বস্তুগুলো ইংরেজিতে ছিল, এখন বাংলা ভাষাকে করেছি মাধ্যম। এক বাংলা একাডেমী ছাড়া আমরা কি কেউ চেষ্টা করেছি, পড়াশোনার যে মূল বই (টেক্সট বুক), তার বাংলা অনুবাদ করি? আমরা হঠাৎ বাংলা করে ফেললাম, কিন্তু তা একটু পরিকল্পিত হলে ভালো হতো না? একটা ট্রান্সলেশন ব্যুরো থাকলে ভালো হতো না?’
আহমদ রফিকের কথা দিয়ে আলোচনা আপাতত সমাপ্ত হয়। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে তো যোগাযোগ হয় বিভিন্নভাবে। দেখি, আমরা মোটামুটিভাবে একই রকম চিন্তা করি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যাপারেও। ভাষা আন্দোলনে আমাদের প্রত্যাশা ছিল কিন্তু শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়। এর একটি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ছিল, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো। দুটি কিন্তু পরস্পর-সংলগ্ন ও তাৎপর্যময় বয়ান। কারণ, প্রাপ্তির প্রশ্নে আমরা দেখি, যুদ্ধ শেষে আমরা ঠিকই একটা রাষ্ট্রভাষা পেয়েছি, একটি মানচিত্র, একটি ভূখণ্ড, একটি পতাকা এবং প্রজাতন্ত্রের সংবিধান। বাহাত্তরের সংবিধানটি ছিল একটি অনন্য সংবিধান, কিছু ভুলভ্রান্তিসহ। সেখানে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাই যদি হয়, তাহলে তার অর্থ কিন্তু বাংলা জাতীয় ভাষা এবং এই জাতির সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার হওয়া দরকার। সেখানে যদি প্রাপ্তির প্রশ্ন তুলি, তাহলে দেখব দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বাংলায় লেখাপড়া হয়, সচিবালয়ের দাপ্তরিক কাজে কিছু বাংলা। তা ছাড়া কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবন—এই দুই ক্ষেত্রেই বাংলার প্রচলন হয়নি। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং উচ্চ আদালতে বাংলা নেই। এটা যে করা যাবে না, তা নয়। বাংলাকে ঘিরে যদি আমাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা না থাকত, তাহলে আমরা দেখতাম, বাংলাকে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং আদালতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে কাজগুলো করা দরকার, যেমন একটু আগেই সুফিয়া আহমেদ বললেন যে ট্রান্সলেশন ব্যুরো, সে রকম অনেক কিছুই আমরা করতে পারতাম। হায়দার সাহেব বললেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে মাতৃভাষার কথাটা। ডেভিডসনের মেডিসিন, ক্যানিংহামের অ্যানাটমির অনুবাদ অনেক টাকা খরচ করে বাংলা একাডেমী ছেপেছে। কিন্তু মেডিকেল কলেজ তা গ্রহণ করেনি। কেন করেনি? সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণীর কাছেই আমার প্রশ্ন, তাঁরা কেন এটা গ্রহণ করলেন না? আমাদের বন্ধু মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর কাছেও অনুরোধ করেছিলাম, ইংরেজি-বাংলা দুই সেট প্রশ্নপত্র হোক; যার যেটা পছন্দ, সে সেটা গ্রহণ করবে। তেমনি আমরা নিজেদের ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা ও অন্যদের অভিজ্ঞতা নিয়েই বলব, অন্তত মেডিকেলের মৌখিক পরীক্ষায় জানা জিনিসটিই বাংলায় যত সহজে তুলে ধরা যায়, ইংরেজি বলতে গিয়ে থতমত খেতে হয়। এ নিয়ে দেশের শাসকবর্গ ভাবেননি। দ্বিতীয় হলো, সর্বস্তরে বাংলা। এটার সঙ্গে কিন্তু জনসাধারণের একটা যোগ রয়েছে। শিক্ষার মাধ্যম যদি বাংলা হতো এবং সর্বস্তরে যদি বাংলা ভাষার প্রচলন হতো, তাহলে গ্রামের মানুষের জন্য সহজে শিক্ষার দিকে এগিয়ে আসা সহজ হতো। আমি বরাবরই মনে করি, শিক্ষিত শ্রেণী ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাথমিক নেতৃত্ব দিয়েছে, তারাই ছিল চালিকা শক্তি। এরপর জনগণ এসে যোগ দিয়ে একে জনযুদ্ধে পরিণত করেছে। দেশের স্বাধীনতা এল। সুবিধাভোগী শ্রেণী কিন্তু এই শিক্ষিত শ্রেণী। সেই তুলনায় কিন্তু রক্তাক্ত জনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের যা পাওয়া উচিত ছিল, তা তাঁরা পাননি। পেয়েছেন অতিসামান্য। বিষয়টি শ্রেণীস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। দেশ যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরাও নিজ শ্রেণীস্বার্থের দিক দিয়েই দেখছেন।
‘এর প্রতিকার কী? প্রতিকার তো একটাই। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলেছেন, শক্তির সঙ্গে শক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে এসে জনগণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনসাধারণের শক্তিকে সংঘবদ্ধ করতে পারেন, তাহলে আমাদের পক্ষে কিছু একটা অর্জন সম্ভব হতে পারে।’
বিদায়ের সময় হয়। বর্ষীয়ান ছয় ভাষাসংগ্রামী এখন চলে যাচ্ছেন। রেখে যাচ্ছেন হিরণ্ময় কিছু সময়, কিছু কথা। তরুণ সমাজের প্রতি তাঁদের ভরসা। আমরা আমাদের তরুণদের কথা ভাবি। ভালো লাগে ভাবতে, নিশ্চয়ই কোনো তরুণ এই ভাষাসংগ্রামীদের কথা থেকে অকস্মাৎ নতুন করে জীবনের মানে খুঁজতে থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.