পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ৩ বছর-আগে হওয়া উচিত ছিল মূল হোতাদের বিচার by আমীন আহম্মদ চৌধুরী

তিন বছর আগে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত হয় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ও বিদ্রোহ। এতে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এই ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, তা বিশ্লেষণ করেছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।


২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যে নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। কেবল পিলখানার ভেতরের লোকেরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, আমি তা মনে করি না। এর সঙ্গে বাইরের লোকও জড়িত ছিল, নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তার পুরোটা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু পত্রপত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে মনে হয় না।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় আমার মনে যেসব প্রশ্ন জেগেছে, প্রথমেই তা পাঠককে জানাতে চাই। বিডিআর বিদ্রোহের মাস তিনেক আগ থেকে গোয়েন্দা ও অন্যান্য সংস্থার পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। এসব প্রতিবেদনে ডাল-ভাত কর্মসূচি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। পরে অবশ্য দেখা গেছে, কোথাও সে রকম দুর্নীতি হয়নি। ডাল-ভাতের কর্মসূচিতে মাত্র দুজন কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে সামান্য অর্থ নেওয়া হয়েছিল কল্যাণ তহবিলে।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে আমি যখনই টেলিভিশনে খবরটা দেখি, যেসব সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাঁদের জানাই গেটে অস্ত্র হাতে একজন দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পায়ে স্লিপার। বিডিআরের কোনো লোক এই কাজ করবে না। হয়তো বিডিআরের পোশাক পরে বাইরের লোক এ কাজ করছে।
পরদিন ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে একটি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে। আমার মনে প্রশ্ন, ডিএডির পদমর্যাদার একজন লোককে তিনি কেন দেখা করার অনুমতি দেবেন। যাঁরা এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন, তাঁরা ঠিক করেননি।
ডিএডি তৌহিদ যখন বললেন, তাঁর জওয়ানরা সবাই আত্মসমর্পণ করবে, তখন পিলখানার ভেতর থেকে একজন বলছিল, ‘আমাদের কমান্ডার আত্মসমর্পণ করতে নিষেধ করেছেন।’ কে তাদের কমান্ডার? রহস্য উদ্ঘাটনে এটি বের করারও দরকার ছিল।
দ্বিতীয়ত, বিডিআর কেন ডাল-ভাত বিক্রি করবে? কে তাদের এই পরামর্শ দিয়েছে। বিডিআরের কাজ সীমান্ত পাহারা দেওয়া। প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার বিষয়টিও দেখতে পারে। আমি মনে করি, এর পেছনে দুরভিসন্ধি ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর বিপুল অবদান ছিল। আমাদের সেনাবাহিনীতে সেই সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার। কিন্তু তৎকালীন ইপিআরের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৩ হাজার; যাদের ৯০ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে গৌরবজনক প্রতিষ্ঠানটিকেও ধ্বংস করা হয়েছে। গুলজারের মতো একজন সাহসী কর্মকর্তা, যিনি বাংলা ভাইকে ধরেছেন, তিনি শুক্রবার পোস্টিং পেয়েছেন এবং ছুটিতে ছিলেন। তাঁকেই বা কেন ডেক আনা হলো? এসব প্রশ্নেরই উত্তর জরুরি।

২.
পিলখানা ট্র্যাজেডির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমি বলব, বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনীর উচিত ছিল অভিযান চালানো। যেখানে বিদ্রোহীদের শক্তি সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল, এলাকাটিও তাদের চেনা, সেখানে প্রতিপক্ষ সংগঠিত হওয়ার আগেই অভিযান চালালে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। অন্তত দ্বিতীয় দিনে বিডিআরের জওয়ানরা নৃশংসতা ও লুটপাট করতে পারত না।
এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই লিফলেট বিলি করেছিল, বিভিন্নভাবে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছিল। এমনকি কাদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ছিল, সে কথাও লিফলেটে প্রচার করা হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে যখন এসব এসেছে, তখন সংশ্লিষ্টদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে ঘটনা অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যেত। আবার যারা এসব লিফলেট বিলি করছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়াও রহস্যজনক।
আমার ধারণা, দায়িত্বপ্রাপ্তরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি। যে কারণে আমাদের সেনাবাহিনী ও দেশ হারিয়েছে ৫৭ জন যোগ্য ও চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে। আর ঘটনার যে অভিঘাত বিডিআরের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ওপর পড়েছে, তা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।
এখন আসি বিদ্রোহ, হত্যাকাণ্ড ও লুটপাটের বিচার প্রসঙ্গে। আমি মনে করি, হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনার বিচার তো প্রচলিত আইনেই করা যায়। কিন্তু বিডিআরে বিদ্রোহের বিচারের কোনো আইন নেই, যেটি আছে সেনাবাহিনীতে। পেনাল কোডে এই মর্মে একটি ধারা যুক্ত করা যেত যে, যে বাহিনীর অস্ত্রধারী সদস্য যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, তা বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য হবে।
আমার বিবেচনায় সবাইকে গয়রহ একই মামলার আসামি না করে বিচারের বিষয়টিও দুই ভাগে ভাগ করা যেত। প্রথমেই যারা এই ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিকল্পনা করেছেন, তাঁদের আলাদা করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা। তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি হতো না। পরে আসত যাঁরা সহযোগী বা পরিস্থিতির কারণে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে বিডিআর বিদ্রোহের তিন বছর পার হয়েছে। যেসব সেনা কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিজন হারিয়েছি, তাদের ফিরে পাব না। কিন্তু আমরা আশা করব, তাদের হত্যার বিচার হবে, অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে।

 আমীন আহম্মদ চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।

No comments

Powered by Blogger.