চারদিক-নবাবগঞ্জের পথে লো

গুলিস্তান থেকে সকাল সাড়ে নয়টায় বাস ছাড়ল। গন্তব্য নবাবগঞ্জ। রাজধানীর এত কাছে, তবু যাওয়া হয়নি। জায়গাটি নিয়ে আমার কল্পনায় একধরনের মুগ্ধতা ছিল। তাই ২১ ভাদ্র সোমবার সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রকৃতিতে রোদ আর মেঘের খেলা। চেয়েছিলাম মেঘলা দিন। মেঘলা দিনে ঘরে থাকতে মন সায় দেয় না। বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে দূরের আমন্ত্রণে।


চলে এলাম বাবুবাজার সেতু। পেছনে রেখে এসেছি রাজধানী ঢাকা। আমি এখন কেরানীগঞ্জে। কত গঞ্জের যে সমাহার জায়গাটি! রাজধানী থেকে, বিশেষ করে পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জকে আলাদা করা কিছুটা হলেও কঠিন। উঠছে নতুন নতুন ভবন। ঢের ধুলোবালু। কিছু কিছু এলাকা জলাবদ্ধ। রাজধানী থেকে একটু বেশি সবুজ, এই যা।
পৌঁছে গেলাম নবাবগঞ্জ উপজেলার ভেতরে। একটা জায়গার কথা আলাদাভাবে ডায়েরিতে টুকে নিলাম। ‘আগলাবাজার’, কী বিচিত্র নাম! আগলা শব্দটার কি কোনো অর্থ আছে?
কিছুক্ষণ পরেই বাস থেমে যাবে। বাস অবশ্য যাবে বান্দুরা পর্যন্ত। নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে কিছুটা সামনে এই বান্দুরা। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার থেকে নবাবগঞ্জের উদ্দেশে যে বাসগুলো ছাড়ে, তার সবগুলো যায় ওই বান্দুরা পর্যন্ত।
নবাবগঞ্জ যাওয়ার পথে ডান দিকে একটি নদী। বড়সড় না হলেও ছোট নয়। নদীর নাম ইছামতী। নামটি শুনে চমকে উঠলাম। এই নামে নদী যেন কোথায় দেখেছি। জানা হলো, বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইছামতী নামে নদীর সংখ্যা ১৩টি।
নদীটি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার সাপেরচরে গিয়ে ধলেশ্বরীর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। ইছামতীতে ঢেউ বেশ। এর মধ্যে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভটভট শব্দ করে চলে গেল। নৌকার ছইয়ে দাঁড়িয়ে জনা দশেক তরুণ গায়ের গেঞ্জি খুলে বাতাসে ওড়াচ্ছে আর নাচছে। ওদের আনন্দ দেখে ভালো লাগল। ঘাটে আরও কয়েকটি নৌকা বাঁধা। বড় নৌকাও আছে। এই নদী দিয়েই অনায়াসে ঢাকায় যাওয়া যায়। একসময় নাকি খুব যাওয়া-আসা হতো। এখন ততটা নয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীপথ কতই না অবহেলিত।
ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম নবাবগঞ্জ। ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ আসতে পৌনে দুই ঘণ্টার মতো লাগল। যানজট ছিল কিছুটা, তার ওপর সড়কের তো মরণদশা। দীর্ঘক্ষণ বাসে বসে থাকলে একধরনের বিরক্তি ধরে। তেষ্টাও লাগে। এক দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে চাঙা হয়ে নিলাম। সঙ্গে স্ত্রী সুমী আর ছেলে স্বচ্ছ। আছেন আমাদের আজাহারুল হক ভাইও।
জনপদটি ঘুরে দেখার ইচ্ছা আমার। মানুষজন, জীবনযাপন, পরিবর্তন দেখতে ভালো লাগে। প্রথমে যাব খেলারাম দাদার বাড়ি। নবাবগঞ্জের অন্যতম আকর্ষণ। সঙ্গী হলো ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। মফস্বল শহরে, গ্রামে-গঞ্জে এই যানটিতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগে। আস্তে চলে। চারপাশের সবকিছু দেখা যায় মনের চোখ দিয়ে।
নবাবগঞ্জ ঢাকার একটি উপজেলা। জনশ্রুতি আছে, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই থানা শহর উদ্বোধন করেন। নবাবের প্রতি সম্মানার্থে তখন থেকেই অঞ্চলটি নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত। তবে নবাবগঞ্জ উপজেলা শহরটি আমার দেখা অনেক জেলা শহর থেকেও বড়। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, নবাবগঞ্জ এখনো পৌরসভা নয়। পানির জন্য নলকূপই ভরসা। হেঁসেলে লাকড়ি চলে। অনেকেই কেনা গ্যাসের ব্যবস্থা করেছেন।
চলে এলাম খেলারাম দাদার বাড়ি। গ্রামটির নাম কলাকোপা। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, বাড়িটি নাকি চার-পাঁচ শ বছর ধরে এমনই রয়ে গেছে। বাড়িটির সামনে শানবাঁধানো একটি পুকুর। পুকুরের সিঁড়ির দুই পাশে সারি সারি কলা, নারকেল আর পেঁপেগাছ। আছে মানকচুও। একপশলা ঠান্ডা বাতাস হাতির কানের মতো মানকচুর পাতায় দোলা দিয়ে মিলিয়ে গেল। শান্তি আর শান্তি। আমার বেসুরো গলা গেয়ে উঠল, ‘যে আকাশ ধরতে চায়, তাকে ধরতে দাও, যে পথ চলতে চায়, তাকে চলতে দাও, যে চোখ খুলে দেখতে চায়, তাকে দেখতে দাও..... হাওয়া বইতে দাও, ঝড় হয়ে এলোমেলো করো’।
এই খেলারাম দাদা সম্পর্কে নানা গল্প চালু আছে। তিনি নাকি ছিলেন ভয়ংকর এক দস্যু। তাঁর দস্যুবৃত্তির গল্প শুনে দুষ্টু ছেলেরাও গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকে মুখ লুকাত।
তবে এই খেলারাম দাদা যতই খারাপ মানুষ হন না কেন, খুব মাতৃভক্ত ছিলেন তিনি। কথিত আছে, একবার খেলারাম দাদার অসুস্থ মা দুধ খেতে চেয়েছিলেন। মায়ের তখন নিদানকাল। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন তিনি। বাড়ির মধ্যে একটি চৌবাচ্চা ভরে দুধ জমা করে মাকে বলেছিলেন, ‘মা, তুমি তোমার যখন ইচ্ছে, এই চৌবাচ্চা থেকে দুধ খাবে।’
বাড়িটি নবাবগঞ্জের একটি অমূল্য সম্পদ। মূল নকশা ঠিক রেখে কিছুটা সংস্কার এর প্রাপ্য। আমার এ রকমই মনে হলো।
অটোরিকশাচালককে বললাম তাঁর ইচ্ছামাফিক চলতে। কখনো মূল সড়ক দিয়ে এগোই, কখনো যাই গ্রামের ভেতর। গ্রামগুলো যেন ঠিক গ্রাম নয়। ইটের রাস্তা, পাকা একতলা-দোতলা বাড়ি। সামনে ফুলবাগান, পেছনে বাড়ি। বাড়ির পেছনে গাছপালাঘেরা পুকুর। বাগানে প্রস্ফুটিত পুষ্প স্বাগত জানায় অচেনা অতিথিকে।
ঘুরতে ঘুরতে বেশ কিছু পুরোনো আমলের বাড়ি চোখে পড়ল। একটি বাড়ি ‘রাজবাড়ি’ নামে পরিচিত, কিন্তু বাড়ির সামনে লেখা ‘জজবাড়ী’। প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বড় পুকুর। পুকুর না বলে অবশ্য দিঘি বলা ভালো।
ফিরে এলাম মূল সড়কে। যে পথটি সোজা পশ্চিমে চলে গেছে, সেটি দোহারের পথ। অটোরিকশা চলতে শুরু করল ওই পথ ধরে।
কাজী আলিম-উজ-জামান
Alim_zaman@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.