স্মরণ-লারার পেন্ডুলামে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর by কাজী রোজী

তবু মনে হয় যেন সেদিন সকাল।’ ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সকাল ১০টা ২৩ মিনিট। আকাশ আগুন তৈরি করল। জ্বলে উঠল বিমান সেসনা-১৫০। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে গেল ঢাকার পোস্তগোলায়। লারার পেন্ডুলাম থেমে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল। আগুনের রঙে পুড়ে পুড়ে নিকষ কালো সেপ্টেম্বরের জন্ম দিল।


সেলিনা হোসেন ও আনোয়ার হোসেন, মা ও বাবার বুকের হাপরে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ জায়গা করে নিল।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সারাক্ষণের কথাগুলো—কন্যা লারাকে ঘিরে লক্ষ স্মৃতিকথা শুধু কথা নয়—বাঁক ফেরা নদীর মতো ভারী ভারী যুদ্ধ-আবেগ। এই যেমন, ‘সেই যে তুমি চলে যাওয়ার এক মাস আগে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলাম। পাহাড়ে, সমতলে হেঁটে যাবার সময় বলতে, আমাকে দেখেশুনে রাখো। একটা আঙুল যদি না থাকে, তাহলে আমাকে প্লেন চালাতে দেবে না। আমার পা দুটো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মা, দেখো, আমার পায়ের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। আর চোখ? চোখ না থাকলে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। এভাবে আলাদা করে প্রতিটি অঙ্গের কথা বলতে। কিন্তু একবারও বলোনি তোমার পুরো শরীরের কথা, বলোনি তোমার হূৎপিণ্ডটাকে দেখেশুনে রাখার কথা।...কী অসম্ভব দ্রুততায় চলে যায় সময়! তাল মেলাতে পারি না সময়ের সঙ্গে। হোঁচট খাই, পড়ে যাই। তুমি আর আমি কি একসঙ্গে “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” সিনেমাটি দেখেছিলাম? মনে পড়ছে না। মনে আমি করতেও চাই না। এখন আমার জীবনে “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” একটি নিদারুণ সত্য। কেমন করে একটি পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে অন্য রকম অর্থ নিয়ে আরেকটি পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করছি। কেন এমন কঠিনভাবে আমাকে জীবনের বোধ বোঝাতে গেলে? কোনো কি প্রয়োজন ছিল? এ জীবনে না-হয় নির্বোধই থেকে যেতাম! তুমি কি জানো, এখন আমার দিন-রাত অনবরত পোড়ে। তোমারই মতো পুড়ে কালো হয়ে যায়। কখনো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এখন তুমি কেমন আছো, প্রিয় লারা?’
বাবা আনোয়ার হোসেনের অস্ফুট উচ্চারণ চোখের অবিরল ধারার সঙ্গে বারবার ভেঙে যাচ্ছিল, ‘কোলেপিঠে করে মানুষ করা মেয়ে আমার। ওর মৃত্যু আমি সহ্য করব কেমন করে...।’
আমায় নিয়ে ফারিয়া লারা বিমান সেসনা-১৫০-এ করে উড়তে চেয়েছিল। আমার ইচ্ছে ছিল, আকাশ-মেঘের বাগানে কিছুক্ষণ মন-পাখির বসতি গড়ব। হয়নি। মানুষের সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়?
কিন্তু লারা, আমার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে বহতা নদীর মতো তুমি সেঁটে আছো। তোমাদের বিষখালী নদীর পানি ছুঁয়ে এই তো সেদিন ২০১১ সালের ১৫ জুলাই তোমাকে বারবার ডাকলাম। তুমি বললে, নাম ধরে ডেকো না আমায়। আমি সবখানে আছি। ইট-বালু-সুরকিতে আছি। আনন্দ-বেদনায় আছি। ছোট-বড় নিঃশ্বাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছি। মা-বাবা খুঁজি না আমি। খুঁজি মানুষের ধুকপুকানি। এক দুই তিন করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এসো...। জানালার গ্রিল ছুঁয়ে সমুখ সুদূর সবুজের নকশায় ঘেঁষে থাকো।
পথ থেকে আরও পথে নেমে ওই দেখো...বৃষ্টি বাতাস ঝড়। সিডর জলোচ্ছ্বাস। ছোট-বড় কষ্টের যাতনায়। ভিতভাঙা মানুষের হাহাকার। রোদে পোড়া কালো কালো পিঠের দাহ। ছড়ায় সীমানা ভেঙে জমাট গভীর দীর্ঘশ্বাস।
রিকশা টমটম ও ভটভটি অঞ্চল যেন এটা। পাখিরা শান্ত থাকে। ফুল ফল জেগে ওঠে অনাবিল আনন্দে। রাতকে দিনের মতো আমি ছুঁতে পারি। যে রকম ছুঁয়েছিনু আকাশপাখির মতো আমার বিমান। ছোট্ট টিপের মতো শূন্যে দ্বীপের মতো, আমি অনিবার একক আমার।
যদি আকাশ ছুঁয়ে যাও, আমি আছি। যদি পাতাল গহিনে রও, আমি আছি। যদি মাটির সবুজে রও, আমি আছি। যুদ্ধলালের সঙ্গে আমি আছি।
একটি দুঃখরাতে বাংলা মায়ের আমি।
একটি আনন্দদিনে বাংলা মায়ের আমি।
সবুজ-লালের বুকে বাংলা মায়ের আমি।
নাম ধরে ডেকো না আমায়। আমি সবখানে আছি। কঙ্কাল-করোটির নিঃশ্বাসে আছি। শহীদ মিনার ছুঁয়ে নিভৃতে আছি। তোমরা ছুঁয়ে দেখো না। ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের আহ্বানে আমি বরগুনার কার্যক্রম দেখতে গেলাম। বিষখালী নদী ছুঁয়ে ঢেউ গুনলাম। একটি ঢেউ চলে গেল। আর এটি সেখানে এল। সব ঢেউ এক নামে বলল আমায়, ‘আমি লারা। আমি তোমাদেরই একজন।’ সেখানে মানবতার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ দেখলাম। অভিভূত হলাম ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন সোপান ছুঁয়ে।
লারা, ১৯৯৪ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত আমি গান লিখেছিলাম জীবনের পাশাপাশি সরণকে ছুঁয়ে। তুমি বলেছিলে, ‘মৃত্যু অনিবার্য হলেও তাকে অতিক্রম করা যায়। এবার সেই আলোকে গান লিখবে, আন্টি।’ গান নয় লারা, তোমার কথাতেই তোমাকে গ্রহণ করলাম। মৃত্যুকে অতিক্রম করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত আমার চোখের সামনে এখন আর কেউ নেই। তেমন করে আমি আর কাউকে রাখতেও চাই না।
লারা, তোমার মা এ দেশের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, তোমার বাবা বিমানের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি আমার সহপাঠী সতীর্থ বন্ধু, তোমার অন্তর ছোঁয়া বোন মুনা, তোমার আদরের ছোট ভাই শমিক—এদের দিন গিয়ে রাত আসবে কষ্টে কষ্টে। এদের কষ্ট যেন জটাধারী ঋষির জটের ভেতরে থাকা বুনট আঁধার। উঁকি দিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করে তোমার দিন-রাত্রির ধারাপাত। তোমার পেন্ডুলামের ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর আমাদের ছুঁয়ে থাকে নিরন্তর, তুমি জানবে, লারা।
কাজী রোজী

No comments

Powered by Blogger.