মূল্যস্ফীতি-অর্থনৈতিক সংকটের গতিপ্রকৃতি by মো. শাহাদাৎ হোসেন

অনেকের মতে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা নাজুক; যার মূলে রয়েছে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের ভঙ্গুর অবস্থা। এর কারণ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান ও চাহিদার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান। বৈদেশিক মুদ্রার জোগানের উৎসগুলো হচ্ছে বৈদেশিক রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, প্রত্যেক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য।
অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাগুলো হচ্ছে আমদানি, সুদসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ। সাম্প্রতিকালের ফরেন রেমিট্যান্সের তথ্যে দেখা যায়, ২০১০ সালে ফরেন রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার পাঁচ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১১ সালে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৭২ মিলিয়ন ডলার। গত ডিসেম্বর মাসে ছিল রেকর্ডপরিমাণ এক হাজার ১৪৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফরেন রেমিট্যান্সের অবস্থা অতটা নাজুক নয়। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রথম ১১ মাসেই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৬২২ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল ৫৮৪ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অবস্থাও খারাপ নয়। যে জায়গায় অবস্থাটি খারাপ তা হলো, আমদানি ও রপ্তানির ব্যবধান।
বাংলাদেশে রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি অর্থাৎ ঘাটতি বৈদেশিক বাণিজ্য। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর—এই ছয় মাসে রপ্তানি ২০১০ সালের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ১৭৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে দাঁড়ালেও আমদানির পরিমাণ আরও অধিক হারে বাড়ার কারণে বাণিজ্যঘাটতি বেড়ে যায়। ২০১১ সালের এই ঘাটতির পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় মূলত ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টালসহ ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য; বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ২৪০ কোটি ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫০ শতাংশ বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৩৬০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ডলার। অতিরিক্ত জ্বালানি তেল আমদানির ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্যঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ বা ৮৯ কোটি ডলার বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রাঘাটতির আরও একটি কারণ হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য প্রায় শূন্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে বিদেশি সহায়তা এসেছে ৪১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। আর এ সময় সুদ ও আসলসহ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রকৃত প্রাপ্তি হয়েছে মাত্র ৪৫ লাখ ডলার। অথচ বিগত বছরের একই সময়ে ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে ছাড় করা হয়েছিল ৬১ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। সুতরাং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানবিষয়ক তথ্য এটিই প্রমাণ করে যে বর্তমানে বৈদেশিক সাহায্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনে বিশেষ কোনো অবদান রাখছে না।
বিশ্লেষণে যা পাওয়া যায় তা হলো, অতিরিক্ত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দিলেও এর ফল অবশ্যই শুভ। বিদ্যুতের ঘাটতি মিটবে। প্রথম আলোর জরিপ অনুযায়ী, ২০১১ সালে ৪৮ শতাংশ মানুষ দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে মন্তব্য করে। এর ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে ২০১২ সালে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রাক্কলনও করা হয়েছে।
ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন শর্ত মেনে ঋণ গ্রহণ এবং বিদেশ থেকে বেশি সুদে ‘সার্বভৌম ঋণ’ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে তা কতটুকু শুভ হবে, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। এই ঋণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির আরেকটি প্রতিকূল দিক হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে তারল্যসংকট। ব্যাংকগুলোতে যখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হয়েছে, তখন দেশি টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার ক্রয় করে জ্বালানি তেলের জন্য লেটার অব ক্রেডিট খুলেছে; ফলে ব্যাংকে নগদ অর্থ কমে গেছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো ২০১০-১১ অর্থবছরে অনেক বেশি ঋণ প্রদান করেছে। বিগত অর্থবছরে ব্যাংকগুলো ৬২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা নতুন ঋণ প্রদান করেছে, যা জুন ২০১০ সালের ঋণের উদ্বৃত্তের প্রায় ২৪ শতাংশ। শুধু ২০১০-১১ অর্থবছরেই নয়, ২০০৯-১০ অর্থবছরেও অনেক বেশি পরিমাণ ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ওই বছরেই জুন ২০০৯-এ ঋণের উদ্বৃত্তের প্রায় ১৪ শতাংশ ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যেখানে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ঋণ প্রদান করা হয়েছিল জুন ২০০৮ সালের ঋণের উদ্বৃত্তের ১২ শতাংশ। এই অতিরিক্ত হারে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণের সব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ঋণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আরেকটি তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালে অতিরিক্ত খেলাপি ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুই হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা ২০১০ সালের খেলাপি ঋণের ১১ শতাংশের অধিক। ডিসেম্বর ২০০৮ সালে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, ২০১০ সালে যা সামান্য পরিমাণে বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা, কিন্তু ২০১১ সালের শেষে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা; যার সিংহভাগই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ধারণা করা অমূলক নয় যে ২০১০ ও ২০১১ সালে যে অতিরিক্ত ঋণ প্রদান করা হয়েছে, তার একটি বড় অংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রদান করা হয়েছে।
অর্থনীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে কর রাজস্ব আদায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। এটি ভালো লক্ষণ। দেশের এই বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি, ব্যাংকিং খাতে ঋণের অবস্থা এবং রাজস্ব আদায়ে সাফল্য বিশ্লেষণে যা দাঁড়ায় তা হলো, আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছে; ফল দাঁড়াচ্ছে ‘কস্ট পুশ’ মুদ্রাস্ফীতি। অধিক পরিমাণে পরোক্ষ এবং পরোক্ষরূপী প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের চাপও দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে। অপরদিকে পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ এক বিশেষ শ্রেণীর হাতে অর্থের জোগান বৃদ্ধি করছে, যা অনেকখানি ‘ডিমান্ডপুল’ মুদ্রাস্ফীতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। দেশের এই প্রতিকূল অর্থনৈতিক অবস্থাকে অনুকূলে আনতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি।
মো. শাহাদাৎ হোসেন: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

No comments

Powered by Blogger.