মুক্তি সংগ্রামের পথিকৃৎ কবি by সুবল চন্দ্র সাহা

আজ ১১ সেপ্টেম্বর। কবি সুফী মোতাহার হোসেনের জন্মদিন। ১৯০৭ সালের এদিনে ফরিদপুর জেলার ভবানন্দপুর গ্রামে কবি জন্মগ্রহণ করেন। কবি সুফী মোতাহার হোসেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি কোনো আত্মজীবনী লিখে যাননি। তাঁর কোনো স্মৃতিকথাও প্রকাশিত হয়নি। কবির পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ হাশিম।
মাতার নাম মোসাম্মৎ তৈয়বুন্নেছা খাতুন। ছোটবেলা থেকেই কবি আত্মভোলা ও ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। তবে ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন। কবি ১৯২০ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পরীক্ষায় পাস করেন। সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯২২ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ৪টি লেটারসহ এফএ (আইএ) পাস করেন। মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে তিনি ভর্তি হন। কবির লেখালেখির অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়। কবিতার পাশাপাশি ছোট গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনায়ও কবি পারদর্শী ছিলেন। ১৯২৭ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক যোগদান করেন। এ সময় কবির লেখা চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট উভয় বাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। কবি মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক কবি রচিত 'দীনান্তে' সনেটের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কবির রচিত 'দীনান্তে' সনেটটি ১৯৪০ সালে কলকাতার বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরে কবিগুরুর সম্পাদিত বাংলা কাব্য পরিচয় গ্রন্থে 'দীনান্তে' কবিতাটি সংকলিত হয়। সনেট রচয়িতা হিসেবে কবির সুখ্যাতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষাজীবন শেষে কবি স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন। ব্রিটিশ ভারতের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতি মুক্তি পাক_ এ ছিল তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন। আর এ লক্ষ্যে পেঁৗছাতে তিনি প্রায় সক্রিয় কর্মী হিসেবে এক যুগ সারা ভারতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময় কবি মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ রাজনীতিবিদের সংস্পর্শে আসেন। হঠাৎ বাখেরগঞ্জ, বর্তমান বরিশাল জেলার স্টিমার ঘাটে কবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের হস্তক্ষেপে মুক্তি পেয়ে ফরিদপুরে চলে আসেন। প্রথমে ফরিদপুরের ময়েজউদ্দিন হাইস্কুল এবং পরে ঈশান স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। আমি ঈশান স্কুলের ছাত্র। স্যারকে আমি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। স্যার মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতেন। ফরিদপুর ঈশান স্কুলের সামনে সে সময়ে একটি মিষ্টির দোকান ছিল। সিকদারের মিষ্টির দোকান নামে খ্যাত। স্যার যে টাকা মাইনে পেতেন তার প্রায় সবই মিষ্টি খেয়ে ফুরিয়ে ফেলতেন। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক শচীন্দ্রনাথ ধরের নজরে আসে। এরপর থেকে বেতনের পুরো টাকা কবিকে দিতেন না। স্কুল কর্তৃপক্ষ বেতনের টাকা কবির বাড়িতে পরিবারের কাছে পেঁৗছে দিত।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কবিকে 'প্রাইড অব পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড' প্রদান করে। কিন্তু পুরস্কার গ্রহণ না করে কবি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। অবিভক্ত ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক কবি সুফী মোতাহার হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত। রোগগ্রস্ত কবি মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করে তুলতে তাঁর লেখা 'সোনার বাংলা' কবিতাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের জন্য মুজিবনগরে পাঠিয়ে দেন। মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে কবিতাটি প্রচারে কিঞ্চিৎ সহযোগিতা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে কবিতাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর কবিতাটি দৈনিক 'সংবাদ' পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৭৪ সালে কবি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমী কবির জীবনী গ্রন্থমালা প্রকাশ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার সংবাদে কবি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। মাত্র পাঁচ দিন পর ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট বিনা চিকিৎসায় কবি মৃত্যুবরণ করেন।
স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত কবি আজ বিস্মৃতির অতল গর্ভে নিমজ্জিত। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ফরিদপুরে গড়ে ওঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সঙ্গত কারণেই জাতি আশা করে, কবির অপ্রকাশিত রচনাসম্ভার প্রকাশিত হবে। কবির জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা।

অ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহা : সভাপতি
কবি সুফী মোতাহার হোসেন
ফাউন্ডেশন, ফরিদপুর

No comments

Powered by Blogger.