মেট্রোরেল-আশার গুড়ে বালি জমছে by এ কে এম জাকারিয়া

মানববন্ধন হয়েছে, সামনে আসছে অনশন। বিষয় মেট্রোরেল। জরুরি বিষয়গুলো যেন আমাদের দেশে সহজে হওয়ার নয়। পদ্মা সেতু আটকে গেছে। কারণ, এটি তৈরি করতে যারা টাকা-পয়সার মূল অংশটি দেবে, সেই বিশ্বব্যাংক মনে করে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দুর্নাম ঘোচাতে সরকারের যেন কিছুই করার নেই।


যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছেন অনেকে, তবে সরকার নীরব। মন্ত্রীকে সরিয়ে দিলে যে দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়! পদ্মা সেতু না হয় না হোক, কিন্তু কোনো মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন, তা সরকার স্বীকার করবে কেন? ইগো বা অহং বলে যে একটি ব্যাপার আছে, তা সরকারের থাকবে না, তা কী করে হয়!
মেট্রোরেল নিয়েও এখন একই অবস্থা। এখানে অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তবে আছে সেই অহং বা ইগোর সমস্যা। বিমানবাহিনী যেসব কারণ দেখিয়ে বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রো রেলপথের আপত্তি জানিয়েছিল, তা বিশেষজ্ঞদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বিশেষজ্ঞ, স্থপতি ও নগরপরিকল্পনাবিদদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে বিমানবাহিনীর প্রস্তাবিত বিকল্প পথও। বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের দাবিতে তাই মানববন্ধন হয়েছে। ঈদ শেষ হয়েছে, এখন অনশনের ঘোষণা আসবে বলে জানালেন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত একজন। কিন্তু বিমানবাহিনীর তরফে যখন একবার আপত্তি তোলা হয়েছে, তখন সেই অবস্থান থেকে সরে আসার যেন আর সুযোগ নেই। ইগো যেখানে বড় হয়ে যায়, সেখানে যুক্তির জায়গাটা থাকে কোথায়? ফলাফল হচ্ছে, পদ্মা সেতুর মতো মেট্রোরেলের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
মেট্রোরেলের রুট নিয়ে সরকারের সর্বশেষ যে অবস্থান জানা গেল, তা বিমানবাহিনীর অবস্থানের পক্ষে। ‘বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে মেট্রোরেলের গতিপথ বারবার ঘুরছে, তা সত্য নয়’—সংসদে এ কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর)। সঙ্গে এ-ও বলেছেন, বুয়েট, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, পরিবেশবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (মানে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে) মেট্রোরেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণের পর যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল তা হচ্ছে, বিমানবাহিনী ছাড়া আর কারা রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার বিষয়টি সমর্থন করলেন? খোঁজখবর নিয়েও এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুয়েট বা পরিবেশবিদদের মধ্যে এমন কাউকে পেলাম না, যিনি বিমানবাহিনীর প্রস্তাবটি সমর্থন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তবে কাদের কথা বললেন?
আমরা দেখলাম, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ২ নভেম্বর বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের রুটের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট। পরিবেশবিদসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নাগরিকেরাও যোগ দিয়েছিলেন এই মানববন্ধনে। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই কানের করা সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত না করার দাবিতে গণস্বাক্ষরও সংগ্রহ করা হয়েছে। আমরা আরও একটু আগে ফিরে যাই। মেট্রোরেলের পথ নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কের বিষয়টি যে প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগের মধ্যে রয়েছে, তা স্পষ্ট। গত ১৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দুটি পক্ষকেই ডেকেছিলেন। স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদদের পক্ষ থেকে ছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব ও বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এস এম জিয়াউর রহমান। প্রধানমন্ত্রী সে সময় ‘আবেগ নয় যুক্তি’ দিয়ে বিষয়টির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসার পরামর্শ দিয়ে দুই পক্ষের জন্য একটি গাইডলাইন ঠিক করে দেন। গাইডলাইন দুটি অনেকটা এ রকম—এক. তেজগাঁও বিমানবন্দরটিকে বর্তমান অবস্থায় সচল রেখেই মেট্রোরেলের রুটের বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। দুই. সব ধরনের বিতর্ক ও বিব্রতকর দিকগুলো এড়িয়ে এই ইস্যুর মীমাংসা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তখন স্থপতি ও পরিবেশবিদদের বিষয়টি নিয়ে বিমানবাহিনীর সঙ্গে বসতে ও তাদের কাছে যুক্তি ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে বলেন। কোনো সমস্যা সমাধানে এর চেয়ে ভালো পথ আর কী হতে পারে!
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে গত ১৫ অক্টোবর স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ ও যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞদের একটি দল বিমানবাহিনীর সঙ্গে বসে এবং তাঁরা দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশানসহ তাঁদের তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁরা সেখানে দেখিয়েছেন যে তেজগাঁও বিমানবন্দরটিকে বর্তমান অবস্থায় সচল রেখেও বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যাওয়া সম্ভব। এই দলটিতে কারা কারা ছিলেন, তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ও কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টসের সভাপতি মোবাশ্বের হাসান, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান এ এস এম ইসমাইল, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও মেট্রোরেল বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সদস্য মো. শামসুল হক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নগরায়ণ ও সুশাসন কমিটির সদস্যসচিব ইকবাল হাবিব। এই দলটির কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, তাঁদের উপস্থাপনায় বিমানবাহিনীকে সন্তুষ্ট মনে হয়েছে। ‘আমরা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বিষয়গুলো বিমানবাহিনীর কাছে তুলে ধরেছি এবং আমরা যে বিষয়টি তাদের বোঝাতে পেরেছি তা তারা স্বীকারও করেছে। আমদের মনে হয়েছে, তারা আমাদের যুক্তি মেনে নিয়েছে’—জানিয়েছেন ইকবাল হাবিব। বিমানবাহিনীর সঙ্গে সেদিনের এই আলোচনা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদ মহলে একধরনের আশা জেগেছিল। এরপর হঠাৎ করেই গত ২৬ অক্টোবর মেট্রোরেল নিয়ে সংসদে বক্তব্য দিলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই তা বিস্মিত করেছে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত স্থপতি ও পরিবেশবিদদের।
‘বিমানবাহিনীর সঙ্গে আমাদের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তাতে বিমানবন্দরের বর্তমান স্বাভাবিক কার্যক্রম অক্ষুণ্ন রেখে বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রো রেলপথ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জার্মানি থেকে ফিরে আসার পর সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিলেন, তা বিমানবাহিনীর সঙ্গে আমাদের ওই দিনের আলোচনার নির্যাস ধারণ করে না। আমার ধারণা, বিমানবাহিনীর সঙ্গে আমাদের আলোচনার ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়নি। কারণ, সেই আলোচনা ইতিবাচক ছিল।’ এটা ইকবাল হাবিবের প্রতিক্রিয়া।
মেট্রোরেলের রুট নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়, তখন বিমানবাহিনীর তরফে একটি ব্যাখ্যা গণমাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল, যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিলেন তাতে বিমানবাহিনীর সেই পুরোনো বক্তব্যেরই প্রায় হুবহু প্রতিধ্বনি শোনা গেল। সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তেজগাঁও বিমানবন্দর সম্পূর্ণ সচল বিমানঘাঁটি। সামরিক ঘাঁটি ও ত্রাণ তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এটি ব্যবহূত হয়ে আসছে। এমআরটি লাইন-৬ (মেট্রোরেল) পথ বিজয় সরণি দিয়ে নির্মিত হলে তা বিমানের আ্যাাপ্রোচ পথে আড়াআড়িভাবে একটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এমআরটি লাইন-৬-এর উচ্চতার কারণে বিমান অবতরণকালে ল্যান্ডিং অ্যাপ্রোচের উচ্চতা বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিমানকে রানওয়ের প্রথম ভাগের একটি বড় অংশ বাদ দিয়ে অবতরণ করতে হবে। এর ফলে ব্যবহার্য রানওয়ের দৈর্ঘ্য আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাবে, যা বিমানবন্দরটিকে বিমানবাহিনীর বিভিন্ন বিমান অবতরণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর)।’
বিমান বাহিনীর দেওয়া যে বক্তব্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর) তার সঙ্গে যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মিলিয়ে দেখতে পারেন। আর বিমানবাহিনীর এই যুক্তিগুলো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কার্যত নাকচ হয়ে গেছে। মাস খানেক ধরে নগরপরিকল্পনাবিদ, বিমান চলাচল ও যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদদের বক্তব্যে বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে।
ঢাকা শহরের জন্য মেট্রোরেল কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও মেট্রোরেল বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সদস্য মো. শামসুল হকের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যা গত ২২ অক্টোবর প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আশা করব যৌক্তিক বিবেচনায় সরকার বিজয় সরণি দিয়েই মেট্রোরেল বাস্তবায়নের দিকে এগোবে। সেটা না হলে বিকল্প যদি সংসদ ভবনের সামনে দিয়েই হয়, তবে আমি বলব, সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হলেও মেট্রোরেল করার কোনো বিকল্প নেই। শহরের মানুষ ও গণপরিবহনের কথা চিন্তা করলে এটা করতেই হবে।’ বোঝা গেল, মেট্র্রোরেলকে ঢাকার জন্য কতটা জরুরি মানছেন তিনি। সরকার কি এখন স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ বা পরিবেশবিদ—সবার আপত্তি উপেক্ষা করে বিমানবাহিনীর অবস্থানকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করবে? যদি তা-ই হয়, তবে কী অগতির গতি হিসেবে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে মেট্রো রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে? এই প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, কাজটি সহজ হবে না।
মেট্রোরেল তৈরিতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা জাপানের। নানা সমীক্ষার পর বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের রুটটি ঠিক করা হয়েছিল। এখন যখন মেট্রোরেলের রুট নিয়ে বির্তক শুরু হয়েছে, তখন একটি বিদেশি সহায্যদাতা প্রতিষ্ঠানের যে অবস্থান নেওয়া উচিত, সেটাই করেছে জাইকা। রুট নিয়ে বিতর্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকল্প নিয়ে এগোবে না তারা। জাইকা অর্থবছর হিসাব করে এপ্রিল থেকে। এখন রুট নিয়ে বিতর্ক শেষ না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে যে এই প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না, তা অনেকটা নিশ্চিত। আর লুই কানের স্থাপত্যের কোনো ধরনের বিকৃতি রোধে শুধু দেশীয় স্থপতিরা নন, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্থপতিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের একটি স্থাপনার বিকৃতি রোধের ব্যাপারে বিশ্বে স্থপতিরা সব সময়ই বেশ সংবেদনশীল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্থপতিরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি পাঠাতে শুরু করেছেন। এশীয় স্থপতিদের সংগঠন আর্কএশিয়ার সভাপতির দায়িত্ব বর্তমানে পালন করছেন জাপানি স্থপতি জর্জ কুনিহিরো। তিনি জাপান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টেরও সভাপতি। গত ২৬ অক্টোবর সংসদে প্রধানমন্ত্রী যখন মেট্রোরেল নিয়ে বক্তব্য দেন, তখন তিনি ঢাকায় ছিলেন। সংসদ ভবনের স্থাপত্যের বিকৃতি রক্ষায় তিনি ইতিমধ্যেই সেচ্চার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন। জাপানের স্থপতিদের পক্ষ থেকে যখন বিরোধিতা শুরু হয়েছে, তখন জাইকার ওপর এর বাড়তি প্রভাব পড়বে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সরকার যা-ই বলুক, মেট্রোরেল নিয়ে ঢাকাবাসীর আশার গুড়ে বালুর স্তর জমতে শুরু করেছে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.