স্মরণ- করিম ভাইঃ একটি রেখাচিত্র by সালেহ চৌধুরী

আজ ২২ ডিসেম্বর ২০০৯। আমাদের সহকর্মী ফজলুল করিম—করিম ভাইয়ের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে দুটি বছর কেটে গেল; অথচ আমাদের মনে এখনও কত উজ্জ্বল তার উপস্থিতি! একটা কিছু উপলক্ষ দাঁড় করিয়ে বন্ধু-সমাবেশ ঘটাতে তার যেন ক্লান্তি ছিল না।

আর অন্য উপলক্ষ না জুটলে শিকার তো ছিলই—মাছ-পাখি-হরিণ—যাই হোক, শিকার মিলল তো আমাদের বাঁধা মোচ্ছব! তখন শিকারে তেমন বিধিনিষেধ ছিল না। আর বিধি-নিষেধ বর্তানোর পরও শিকারের নেশা তার কাটেনি। সরকারি অনুমতি নিয়ে নিয়মিত শিকারে যেতেন—মনে হতো এর সবই বুঝি আমাদের আপ্যায়নের জন্য। এমনিতে করিম ভাই হিসেবি মানুষ বলেই পরিচিত ছিলেন, কিন্তু বন্ধুদের ক্ষেত্রে বরাবরই ছিলেন দরাজহস্ত। কেবল উপলক্ষটা মনোমত হলেই হলো। এমন একজন বন্ধুকে ভুলে যাওয়া কি সম্ভব?
তার বন্ধু-পরিমণ্ডলও ছিল সুবিশাল। সাংবাদিকরা তো বটেই, রাজনৈতিক নেতা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী, ব্যবসায়ী থেকে সমাজের সাধারণ স্তরের অনেকেই ছিলেন তার অন্তর্ভুক্ত। তবে হ্যাঁ, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ গুণ থাকা চাই। রন্ধনবিদ্যায় হলেও ক্ষতি নেই।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, করিম ভাই নিজেও ছিলেন রন্ধনে পারদর্শী। আমাদের যখন বাসায় ডাকতেন, প্রায় সমুদয় রান্নাই করতেন নিজে। আমি লক্ষ্য করেছি, কোথাও একটা কিছু রান্না ভালো লাগলে তিনি রন্ধন-প্রণালীটা জেনে নিতেন। আর প্রথম সুযোগেই তা নিজে করে কৌশলটা রপ্ত করে নিতে ভুলতেন না। তার এ দক্ষতা বলে পেশাদার বাবুর্চিদের কাছ থেকে অনায়াসে আদায় করে নিতে পারতেন সেরা কাজ। করিম ভাইয়ের ব্যবস্থাপনায় বনভোজনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, নির্দ্বিধায় তারা এ কথা স্বীকার করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
উদার অসাম্প্রদায়িক করিম ভাইয়ের আপ্যায়নের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল রুচিশীল পরিবেশন। আপ্যায়নের সঙ্গে পানীয় যুক্ত থাকলে যা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ত। কিসের সঙ্গে কোন গ্লাস যাবে, এসব ব্যাপারেও তার ধারণা ছিল স্থির। আর কখনও তার ব্যত্যয় হতে দিতেন না।
একজন ভাষাসৈনিক, সাংস্কৃতিক কর্মী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার জীবনের তুলনামূলকভাবে হাল্কা দিকগুলো টেনে আনা উদ্দেশ্যহীন নয়। কেননা এই হাল্কা ভূমিকাতে একজন মানুষের পরিচয় যত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে, অন্য কিছুতে তা হওয়ার নয়। গুরুতর কাজে অনায়াসেই মুখোশ এঁটে চলা যায়। মুখোশ দিয়ে মনের নাগাল পাওয়ার নয়। সাংবাদিক ফজলুল করিম কাজের ক্ষেত্রে গাম্ভীর্যের আর কঠোরতার এমন একটা মুখোশ ধারণ করে চলতেন যে, সব সময় তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর পক্ষেও হৃদয়ের উত্তাপ আন্দাজ করা সম্ভব হতো না। ফলে অনেক সময়ই তাকে ভুল বোঝা হতো। আর করিম ভাইয়ের কাজের ধারাই ছিল এমন যে, কে কী ভাববে আর কি বলবে তা নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না।
নিজে যেমন কাজ করতে জানতেন, তেমনি জানতেন কাজ আদায় করে নেয়ার কৌশল। উদাহরণ হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারি। অনেক কিছুই এক-আধটু করতে পারি। করার শখও আছে। কেবল আলসেমির জন্য করা হয় না। করিম ভাই একবার গাছপালা নিয়ে একটা পাণ্ডুলিপি দাঁড় করালেন। ঠিক করলেন আমাকে দিয়েই বইয়ের সবগুলো ছবি আঁকিয়ে নেবেন। নেহাত কম নয়, গোটা পঞ্চাশেক তো হবেই। নিজের জন্যও অতটা কাজ একটানা করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। করিম ভাই কিন্তু মাত্র দুটি বৈঠকে আমাকে দিয়ে তার প্রয়োজনীয় তাবত্ ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন, আমার কাছেই যা অবিশ্বাস মনে হয়।
এই গুণটিই তাকে পেশায় এগিয়ে যেতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। দৈনিক বাংলার নগর সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংসদের অধিবেশন চালু থাকলে তার প্রতিবেদনও তিনিই করতেন। এ কাজে তিনি অতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, এ বিষয়ের ওপর তার একটা বইও প্রকাশিত হয়েছে প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে। ফজলুল করিম যখন যা করতেন, তাতে পূর্ণশ্রম আর মনোযোগ দেয়ার অন্যথা কখনও করতেন না।
খেলাধুলাও তার মনোযোগের বাইরে ছিল না। একসময় প্রেসক্লাবের একটা ক্রিকেট টিম ছিল। তিনিই ছিলেন তার অধিনায়ক। জাতীয় শ্যুটিং ফেডারেশনকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য দীর্ঘদিন তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এজন্য তাকে অনেক অপবাদও সইতে হয়েছে। তিনি কিন্তু তাতে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াননি। এক কথায় বলা যায়, সৈনিকের দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।
এমনি অশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন আমাদের সহকর্মী আর প্রিয় বন্ধু ফজলুল করিম। মৃত্যুদিন কিংবা বিশেষ কোনো উপলক্ষেই নয়, নানাভাবেই তার স্মৃতি মনজুড়ে বসে; আর তখনই নীরবে শ্রদ্ধা জানাই তার প্রতি। তার সঙ্গে আমরা যা হারিয়েছি, তা কখনও ফিরে পাওয়ার নয়।

No comments

Powered by Blogger.