অধ্যাপক ইউনূস-পরবর্তী অধ্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ খাত-অর্থনীতি by মামুন রশীদ

এটা সবাই স্বীকার করেন যে, ক্ষুদ্রঋণ এবং অধ্যাপক ইউনূস সমার্থক। কিন্তু এখন তিনি স্থানীয় মঞ্চে আর সক্রিয় নেই। কিন্তু আমরা দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতা বাড়ানোর এ কার্যকর উপায়কে খাটো করে দেখতে পারি না। এর প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেওয়ারও অবকাশ নেই। বিশেষ করে আমাদের মনে রাখতে হবে গ্রামীণ বাংলাদেশের কথা।


কেউ মানুক আর না-ই মানুক, এটাই বাস্তব যে, বিআরডিবি কিংবা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রত্যন্ত গ্রামে খুব একটা পেঁৗছাতে পারেনি। যতদিন ক্ষুদ্রঋণ খাত ইনক্লুসিভ প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ততদিন তার প্রতি আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যেতেই হবে


ক্ষুদ্রঋণের প্রসারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আন্তরিক চেষ্টা চালিয়েছেন এবং এর স্বীকৃতি ছিল তার ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পুরস্কার জয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি পেছনের সারিতে চলে গেছে। এ নিয়ে অনেক কম আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগও যথেষ্ট কম বলেই মনে হয়, যদিও সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। অধ্যাপক ইউনূসও 'সামাজিক ব্যবসা' নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ বাস্তবতায় ক্ষুদ্রঋণ খাত মনে হচ্ছে 'পথহারা'।
বিশ্বে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত যথেষ্ট দক্ষ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। এর প্রসারও সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছে। মাইক্রোফিন্যান্স ইনফরমেশন এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা নিয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ লোক, ভারতে এ সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখ এবং গোটা এশিয়ায় ৫ কোটি ৮০ লাখ।
মোট ঋণ পোর্টফোলিও নিয়েও বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। এর পরিমাণ ২৫০ কোটি ডলার, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যা ৪৭০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে ঋণগ্রহীতাপিছু ব্যয়ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি এবং তাদের ৩১.৫ শতাংশ জীবন কাটায় দারিদ্র্যসীমার নিচে। এ বাস্তবতায় ক্ষুদ্রঋণ প্রসারের এখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ এখন কৃষি খাতের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়েছে। বর্তমান সরকারও দরিদ্রবান্ধব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিযোগিতামূলক সুদের হারে সরাসরি কৃষি ব্যবসায় ঋণদানের জন্য সব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে। যেখানে ব্যাংকিং সুবিধা নেই সেখানে ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ঋণ বিতরণ করতে পারবে।
তবে ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিলের প্রধান উৎস এখনও রয়ে গেছে সদস্যদের জমা এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত আমানত গ্রহণ ও ঋণদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে তাদের সদস্যদের কাছ থেকে সংগঠনে যুক্ত হওয়ার সময় বাধ্যতামূলকভাবে সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখা অর্থের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিংবা তারা অন্য সূত্র থেকে ঋণ সংগ্রহ করে। কোনো কোনো বিশ্লেষক যুক্তি দেখান, ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দাতাদের সমর্থন তাদের মূলধারার আর্থিক খাতের সঙ্গে একীভবনের পথে প্রতিবন্ধক কি-না সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
২০০৯ সালে মাইক্রোফিন্যান্স ব্যানানা স্কিন্স শিরোনামে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এ ব্যবসার ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা হয়। এ জরিপের ওপর আলোচনায় বিশিষ্টজনরা অভিমত দেন, ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ঝুঁকির মাত্রা ভারত, পাকিস্তান এবং আরও কয়েকটি উন্নত দেশের তুলনায় এখনও যথেষ্ট কম। এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত হয়েছে_ পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি, ক্ষয়প্রাপ্ত ভাবমূর্তি এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অনুপস্থিতি।
ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ অন্য সব ব্যাংকের তুলনায় উচ্চ আদায়ের হারের কারণে ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার কথা। বিশ্বে মন্দার কারণে সর্বত্র ঋণ আদায়ের হারে শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। এ সংকটের কারণে ঋণের ঝুঁকি বাড়বে বলেই ধরে নেওয়া হয়। ক্ষুদ্রঋণের অনেক গ্রহীতার জীবনযাপনে এ সংকট প্রভাব ফেলছে। আর সংকট এমন এক সময়ে এসেছে যখন ক্রেডিট মান কিছুটা কমেছে এবং সময়মতো ঋণ ফেরত না দেওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা বাড়বে বলে ধারণা করা হয়।
বিভিন্ন ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা ঋণের মান কমিয়ে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাজারের হিস্যা বজায় রাখা কিংবা তা আরও বাড়াতে প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে ঋণগ্রহীতাদের জন্য শর্ত সহজ করছে। গ্রুপ-ঋণ থেকে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিগত ঋণের প্রতি মনোযোগী হওয়া থেকে এর প্রমাণ মেলে। দু'একটি ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক রিপোর্টিং মান অনুসরণ করে না। গ্রহীতাদের মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের সংখ্যা অনেক এবং এ ধরনের নজরদারি প্রকৃতই অসাধ্য কাজ। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের জন্য একটি তথ্য-ব্যাংক গড়ে তোলার তাগিদ প্রবল।
দ্বিতীয় ঝুঁকি হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়প্রাপ্ত ভাবমূর্তি। তাদের জনহিতৈষী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবা হয়ে থাকে, কিন্তু বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বেশি যুক্ত হয়ে পড়ার কারণে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, তারা যে প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করছে, ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে সেখানে যেতে চায় না বা পারে না। তার পরও তথ্য-পরিসংখ্যান এটাই বলছে যে, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনিরাপদ ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারদের জন্য নির্ধারিত হারের তুলনায় কম।
তৃতীয় ঝুঁকি, যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক তা হলো ব্যবস্থাপনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করে। মূল ব্যক্তির হাতে থাকে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। ঐতিহাসিকভাবে ভালো শিক্ষায় যোগ্য ও পেশাগতভাবে দক্ষ ব্যক্তিরা এ মডেল নিয়ে নানা সংশয় ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সমস্যার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখাননি। সঙ্গত কারণেই ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা দুর্বল রয়েছে। উত্তরাধিকার পরিকল্পনাও যথাযথভাবে লক্ষণীয় নয়।
এখন বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৬ বলবৎ রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি কর্তৃপক্ষও রয়েছে। এ অবস্থায় রিপোর্টিং পদ্ধতি আরও উন্নত ও অভিন্ন হবে, এটা আশা করা যায়। তাদের জন্য থাকতে হবে যথাযথ নীতিগত নির্দেশনা। ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য-ব্যাংক গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এসব প্রতিষ্ঠান যেন আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে, সে জন্য তাদের প্রতি সক্রিয় সমর্থন প্রদানও অপরিহার্য।
এখন বলা যায়, ক্ষুদ্রঋণদান শিল্প এক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। একে উন্নত ধাপে নিয়ে যেতে হলে রিপোর্টিং মান বাড়াতে হবে এবং সময়মতো ঋণ আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। মূল ধারার আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে একীভবনও গুরুত্বপূর্ণ।
এটা সবাই স্বীকার করেন যে, ক্ষুদ্রঋণ এবং অধ্যাপক ইউনূস সমার্থক। কিন্তু এখন তিনি স্থানীয় মঞ্চে আর সক্রিয় নেই। কিন্তু আমরা দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতা বাড়ানোর এ কার্যকর উপায়কে খাটো করে দেখতে পারি না। এর প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেওয়ারও অবকাশ নেই। বিশেষ করে আমাদের মনে রাখতে হবে গ্রামীণ বাংলাদেশের কথা। কেউ মানুক আর না-ই মানুক, এটাই বাস্তব যে, বিআরডিবি কিংবা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রত্যন্ত গ্রামে খুব একটা পেঁৗছাতে পারেনি। যতদিন ক্ষুদ্রঋণ খাত ইনক্লুসিভ প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ততদিন তার প্রতি আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যেতেই হবে।

মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
mamun1960@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.