ডিজিটাল যুগের রোবট যেন না হই-তরুণ প্রজন্ম by নওশিন ফাহিম

আমার জন্মের পরপরই '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। কাজেই সে আন্দোলন আমার দেখা হয়নি। একদিন কিছুটা আগ্রহী হয়ে ইন্টারনেটে খোঁজ করে জানলাম এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নানা কথা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা। নেটে লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, সেই সময়ের প্রতিবাদী বাঙালি কি আজ গণতন্ত্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে? তাই প্রতিবাদ করার কিছু নেই? উত্তর পেলাম নিজের আচরণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে।
ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি, বোবার কোনো শত্রু নাই। পৃথিবীর সব মানুষ, এমনকি আমিও শান্তিতে থাকতে চাই। তাই আমরা অন্যের দুর্দিনে চুপ করে বসে থাকি। যারটা সে বুঝে নেবে। আমার এত ঝামেলা করার দরকার কি? খাচ্ছি, পড়ছি, চাকরি করছি, নিজের টাকায় কেনাকাটা করছি। আমি তো বেশ ভালোই আছি_ এটা হচ্ছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ টিপিক্যাল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানুষের মনোভাব। আমি যেহেতু ভালো আছি, কাজেই কেউ মরল নাকি পুড়ল, রাস্তা কি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, দেশের শেয়ারবাজারে ধস নামল কি নামল না, তা দেখার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার নেই। 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ' তাড়ানোর কী দরকার? আমরা ভাবি না, অন্যের ঘরে যে বিপদ, ঠিক সেই বিপদ একদিন আমাদের ঘরেও আসতে পারে। আমরা ডিজিটাল যুগের রোবট হয়ে গেছি।
বহুদিন আমরা, বাংলাদেশের মানুষ কোনো আনন্দের ঘটনা শুনিনি, যে আনন্দে মেতে উঠবে সারা দেশ। অথচ মন খারাপ করা ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষিত হয়েছে ছাত্রী, স্বামীর পৈশাচিক নির্যাতনে অন্ধ হয়ে গেছেন রুমানা সাঈদ, পা হারিয়েছে লিমন। চিরকালের মতো চলে গেছেন তিনজন ক্ষণজন্মা প্রতিভা আবিদ, মিশুক মুনীর এবং তারেক মাসুদ। মীরসরাইয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে গেছে অনেক শিশুর প্রাণ। এই ঘটনাগুলো নিয়ে বল্গগে, ফেসবুকে, পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে দেখে এগুলোর কথাই আমরা বেশি বলি। হয়তো আরও মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের চোখের অন্তরালে। আমরা যারা সক্রিয়ভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করি তারা আজকাল এমন নিস্পৃহ হয়ে গেছি যে, কোনো হত্যাকাণ্ড বা দুর্ঘটনার কথা শুনলেই ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে থাকি প্রতিবাদী স্ট্যাটাস অথবা বল্গগের জন্য প্রস্তুত করতে থাকি নোট। আমাদের কতটুকু মন খারাপ হয়, তার তুলনায় কত গুণ বেশি আমরা কয়েক দিন মিডিয়াতে কথা বলি_ মনে হয় আমরা নিজেরাই জানি না। আসলে কি বোর্ডে খট্ খট্ শব্দ তুলে কিছু লেখা লিখে শোক ঝরিয়ে দেওয়া অনেক সহজ ব্যাপার। সেই খটখটে শোক মুছে ফেলে সবকিছু ভুলে যাওয়াও খুব সহজ ব্যাপার। নতুন করে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে মিডিয়াগুলো আবার সরব হবে। আমরাও সরব হব। শোক প্রকাশ করব, প্রতিবাদ জানাব। এক সময় থেমে যাব চিরাচরিত প্রথায়। আমরা কি তাহলে দুর্ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা করি? অপেক্ষা করি ঘরে বসে ডিজিটাল মিডিয়াতে প্রতিবাদের?
বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইব্রাহিম তার ছাত্রদের একটা কথা বলতেন, 'তোমরা রোগীদের প্রতি সহানুভূতি না, সহমর্মিতা প্রদর্শন কর।' এখানে সহমর্মিতা মানে কী? এখানে সহমর্মিতা মানে হচ্ছে, একজন অসুস্থ মানুষ যে পরিস্থিতিতে আছে, সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে। মানুষকে অনুভব করতে হবে নিজেকে দিয়ে। আমরা কতজন নিজেকে দিয়ে অন্যকে অনুভব করি? যদি আমরা আসলেই সহমর্মী হতাম, তাহলে পরিমল দ্বারা নিপীড়িত আমাদের সেই ছোট বোনটি কেমন আছে, কতটা কষ্ট পাচ্ছে সেটি আগে অনুভব করতাম। তার পোশাক নিয়ে মাতামাতি করতাম না। রুমানা সাঈদের দোষ খোঁজার আগে অনুভব করতাম একজন অন্ধ মানুষকে, যিনি কিছুদিন আগেও পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ অনুভব করেছেন। তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর অবিবেচক মন্তব্য করার আগে আমাদের মন্ত্রী মশাই যদি একবার অনুভব করতেন তারেক মাসুদের ছেলে নিষাদের কষ্ট অথবা মীরসরাইয়ের শিশুদের পরিবারে এক লাখ টাকা তুলে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসার আগে মন্ত্রীরা যদি অনুভব করতেন সেই পরিবারগুলোর বুকফাটা আর্তনাদ, তাহলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারত। কিন্তু ক্ষমতার কাছে আজ অনুভূতি পরাজিত।
আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতিবিরোধী। কোনো একটা অঘটন ঘটলেই আমরা মন্ত্রীদের গুষ্টি উদ্ধার শুরু করি। কিন্তু যখন ভোটের সময় আসে আমরা ভোট দিয়ে আসি সেই রাজনীতিকদের। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও দুটি দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে। অবশ্য আমাদের মতো আমজনতার আসলে কী-ই বা করার আছে এই দুটি দলকে ভোট দেওয়া ছাড়া? সাধারণ মানুষের পক্ষে একটা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা সম্ভব নয়। সবখানেই যখন দুর্নীতি, তখন সুনীতির পক্ষে সাফাই গাওয়া মানুষের সংখ্যা কম হবে এবং কেউ সাফাই গাইলেও তাকে ধরেবেঁধে থামিয়ে দেওয়া হবে_ এটা তো আমাদের দেশের সাধারণ চিত্র।
একটা পরিবর্তন মনে হয় খুব বেশি প্রয়োজন। নাটকের একটা চরিত্র 'বাকের ভাই'-এর জন্য যদি এ দেশের মানুষ রাস্তায় মিছিল করতে পারে, তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ফাঁসির আসামি ছাড়া পেয়ে যাওয়া, মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রতিবাদে সবাই একত্রিত হয়ে কেন রাস্তায় নামে না? পরিবর্তন কি তবে আমরা চাই না? উত্তর_ আমরা আসলে পরিবর্তন চাই না। আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই। নিজেদের পরিবার-পরিজনের মাঝেই আমাদের জীবন সীমাবদ্ধ। আমরা ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আমরা 'চাচা আপন প্রাণ বাঁচা' নীতিতে চলতে চাই। আমরা দূর থেকে পলান সরকার অথবা জয়নাল চাচার দেশপ্রেমকে স্যালুট জানাই। কিন্তু নিজেরা ভালো কিছু করতে আগ্রহ বোধ করি না।
আমি চাই, আমাদের সবার মধ্যে লুকিয়ে থাকা দেশপ্রেম জেগে উঠুক। আমরা তরুণ প্রজন্ম দেশটাকে নিয়ে ভাবি, দেশের জন্য কাজ করি, দেশটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত কিছু লেখা লিখি। সেই লেখার অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠুক প্রতিবাদ, আর আমাদের ভেতর থেকে উঠে আসা উচ্চারণগুলো হোক শোকের।

নওশিন ফাহিম : শিক্ষার্থী, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
 

No comments

Powered by Blogger.