দান ও সেবার মহান শিক্ষা-বৌদ্ধ মধু পূর্ণিমা by সুকোমল বড়ূয়া

আজ শুভ মধু পূর্ণিমা। এটি সারাবিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য অন্যতম এক শুভ তিথি। বিশেষ করে এই শুভ দিনটি বাংলাদেশ-ভারতসহ থেরবাদী বৌদ্ধ দেশ শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় বেশ উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে পালিত হয়। বর্ষাবাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমা তিথি ভাদ্র মাসেই এ উৎসব উদযাপন করা হয় বলেই এর অপর নাম ভাদ্র পূর্ণিমা। তবে বিশ্বে এটি মধু পূর্ণিমা নামে অধিক পরিচিত। বুদ্ধ জীবনের নানা ঘটনায় এ পূর্ণিমা তিথিটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিক থেকে বেশ গুরুত্ব বহন করে।
বৌদ্ধরা এদিন বিহারে গিয়ে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধু দানসহ নানা ধরনের পুষ্প, ফল ও খাদ্যদ্রব্যাদি দান করে থাকেন। এই শুভ দিনটি বৌদ্ধরা নানা উৎসব ও আনন্দে এবং যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পালন করে থাকেন। বিশেষ করে বৌদ্ধ শিশু-কিশোর, বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণীসহ সব শ্রেণীর নর-নারী সেদিন বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধু দান করার জন্য উৎসবে মেতে ওঠেন। সেদিন বিহারে দেখা যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মধু দানের এক আনন্দঘন পরিবেশ। বিশেষ করে বানরের সেই মধুদান ও বন্যহস্তীর সেবাদানকে কেন্দ্র করে যেই ঘটনা বিজড়িত তাকে স্মরণ করার জন্যই দান, ত্যাগ ও সেবার মহৎ আদর্শে এ পূর্ণিমার আবেদন চিরভাস্বর হয়ে আছে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে।
বুদ্ধজীবনে আমরা দেখি মানব ও জীবজগতের হিতার্থে বুদ্ধ তার কল্যাণময় বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানা স্থান পরিভ্রমণ করেছেন; গেছেন গভীর অরণ্য, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ও গুহাতে। বুদ্ধ জ্ঞান ও দুঃখ অনুসন্ধানের জন্য যেমন কোনো স্থান বাদ দেননি, তেমনি ধর্মবাণীও ছড়িয়ে দিতে কোনো স্থান বাদ দেননি। আমরা জানি, বুদ্ধ ধর্মপ্রচার জীবনে দীর্ঘ পঁয়তালি্লশ বছর বর্ষাব্রত পালনের জন্য একবার পারলেয়্য বনে গিয়েছিল। সেখানে তিনি নানা পশু-পাখি ও জীবজন্তু দ্বারা সেবা পেয়েছিলেন নানাভাবে। তাই এ মধু পূর্ণিমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই পারল্যেয় বনে বানরের মধুদানের এক বিরল ঘটনা এবং সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক হস্তী দ্বারা বুদ্ধকে সেবাদানের এক অপূর্ব কাহিনী।
বানরের মধুদান এবং বন্যহস্তী দ্বারা বুদ্ধকে সেবাদান প্রভৃতি ঘটনা বৌদ্ধ ধর্মদর্শন ও অধ্যাত্ম সাধনার জন্য একেবারে নিছক ঘটনা বলে মনে হলেও এর থেকে আমরা বাস্তব জীবনের অনেক মহৎ শিক্ষা পেয়ে থাকি। যেমনি পেয়ে থাকি পরোপকার, দান, সেবা ও আত্মত্যাগের মতো মহৎ শিক্ষাও। বনের পশু-পাখি ও হিংস্র জীবজন্তু হয়ে যদি একজন মানুষের প্রতি উদার মমতা আর নিস্বার্থ দয়া, ভালোবাসা দেখাতে পারে, তাহলে আমরা আজ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়েও সেই মমতা ও সেবাদান দেখাতে পারছি না কেন? বর্তমান বিশ্বে আমরা দেখছি বনের পশু-পাখি, জীবজন্তুরাও প্রভুভক্তি দেখায়, মানবতা দেখায়। কিন্তু আমরা আজ মানুষ হয়েও সে প্রভুভক্তি কিংবা মানবতা দেখাতে পারছি না। আজ বিশ্বে মানবতার সেবা বিপন্ন হচ্ছে। দান, ত্যাগ ও পরোপকারিতা নির্বাসিত হতে যাচ্ছে। মানুষ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন করছে না। মানুষ মানুষের জীবন সংহার করছে দেখেশুনে। এটাই কি মানুষের ধর্ম? এটাই কি মানবতার ধর্ম? এগুলো দেখে আজ মনে হাজারও প্রশ্নের উদয় হয়। বিবেক ক্ষত-বিক্ষত হয়। কিন্তু প্রতিকারের কোনো উপায় নেই। এ ছাড়াও কত করুণ দৃশ্য দেখছি প্রতিনিয়ত। এসব দৃশ্য দেখলে চিত্ত ব্যথিত হয়, চিত্ত নীরবে কাঁদে। শুধু চিত্তকে সান্ত্বনা দেই। কারণ করার তো কিছুই নেই।
দেশের সর্বস্তরে আমরা আজ এই করুণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। অন্যদিকে আবার চলছে দান ও সেবার বিনিময়ে কত বিপন্ন ব্যবসা আর জঘন্য অপরাধ ও নির্মমতা! মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে বনের হিংস্র পশু-পাখি ও জীবজন্তুর চেয়েও অনেক খারাপ। আমরা আগে তাদের দেখলে অবজ্ঞা করতাম, অবহেলা করতাম। এখন তারা আমাদের দেখে অবজ্ঞা করে, অবহেলা করে। এমনকি আগে আমরা বনের পশু-পাখি ও জীবজন্তু দেখলে ভর্ৎসনা করতাম, গাল-মন্দ করতাম। কিন্তু এখন তারা আমাদের দেখে ব্যঙ্গ করে, ভর্ৎসনা করে। কারণ বর্তমান বিশ্বে এখন আমরা সব ধরনের মনুষ্যত্ব ধর্ম ও মানবতার গুণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা হয়ে গেছি আগের আদিম অসভ্য বর্বরের চেয়েও খারাপ। দিনদুপুরে মানুষ খুনখারাবি করছে। এমনকি পবিত্র শবেবরাতের রাতেও আমরা তরুণ ছাত্রদের নির্মম লাঠিপেটা করে খুন ও হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করছি না। এটাই কি মানবতা? এটাই কি সভ্যতা? এসব দেখে আমি নিজেকে ধিক্কার দেই।
তাই তো বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন শিক্ষা হচ্ছে অহিংসা, মৈত্রী এবং মানবতার শিক্ষা। এজন্যই বৌদ্ধধর্ম সব সময় মানব জাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ, সুখ, শান্তি এবং মর্যাদার কথা বলে। মানব জাতির সব ধরনের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের কথা বলে।
তাই বলতেই হয়, প্রত্যেক ধর্মের পূর্ণিমা তিথি ও উৎসব পার্বণগুলো শুধু বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান কিংবা আড়ম্বরের জন্য আসে না; বছর পরিক্রমায় আসে আমাদের হৃদয়বৃত্তির মানবীয় গুণের আগমনকে স্বাগত জানাতে। পাশাপাশি দায়িত্ব-কর্তব্য তো আছেই; আরও আছে নিজকে বড় ও প্রদীপ্ত করার উত্তম শিক্ষা। তাই তো এসব উৎসব-পার্বণ কিংবা পূর্ণিমা তিথির আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিজেকে যেমন সুন্দর ও পরিশুদ্ধ করা যায়, তেমনি করা যায় নিজের মনের গ্গ্নানি আর হিংসা-লোভকে দূর করাও।
পরিশেষে বলি, আজ এই মধু পূর্ণিমা আমাদের সবার জীবনে শান্তি ও কল্যাণের মধুময় জীবন নিয়ে আসুক। আমাদের সবার জীবন শান্তি-প্রীতি এবং অপার আনন্দে মধুর মতো হোক। আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক অপার মৈত্রী, করুণায় এবং দয়া, সেবা আর অকৃত্রিম ভালোবাসায়। সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু_ জগতের সব জীব সুখী হোক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং_ সবার মঙ্গল লাভ হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক।

প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ূয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার

No comments

Powered by Blogger.