তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধান সংশোধন-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by নির্মল সেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে। তাই সে মতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধি বাদ দেওয়া হয়েছে। আর বিরোধী দলের নেত্রী বেগম জিয়া বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবেন।


'সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া'র মানে কী দাঁড়ায়, তা বিতর্কসাপেক্ষ। বেগম জিয়ার এ কথার পেছনে অনেক কথা আছে, তা আমি পরে লিখব। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যদি শক্তিশালী হয় তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশন নিয়ে। আমি যতদূর বেতার, টেলিভিশনের টক শো শুনেছি এবং পত্রিকায় সাক্ষাৎকার পড়েছি, অধিকাংশ বক্তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলেছেন। তারা বলেছেন, এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। এমনটি আগে হয়নি। তাই বেতার, টেলিভিশনের অনেক শ্রোতা ও পত্রিকার পাঠক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন।
আমার একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হুদা সাহেব আমার চেনা। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর একটি বিধি করলেন। বিধিটি হলো, যেসব রাজনৈতিক দল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি আসনেও নির্বাচিত হতে পারেনি সেসব দল নিবন্ধন পাবে না। আমি তখন শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক। আমরা দেশ স্বাধীনের পর প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারিনি। আমি এবং আমার দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে যাইনি। আমরা সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন করতে পারিনি। পরবর্তীকালে দেখলাম, অনেক নতুন দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে আমাদের দলের নাম পাল্টে ফেলেছি। তিনটি দল এক হয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি গঠন করেছি। এ দলকেও আলোচনায় নির্বাচন কমিশনার ডাকেননি। আমি বুঝতে পারছি না নির্বাচন কমিশনার কী চান? ইতিমধ্যে আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। আমি বলেছিলাম, নির্বাচন কমিশনার আমাকে না ডেকে ভালো করেছে। কারণ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, আপনি কে? কী আপনার পরিচয়? আপনাকে কে নিয়োগ দিল? তাতেই বেরিয়ে যেত তারা কারা। তাদের নিয়োগ দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে কাজ করেছেন। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাল্টে গেছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের মতামত কী? এখন তারা কী মনে করেন? আমাকে ডাকা হলে আমি জিজ্ঞাসা করতাম, কোন নির্বাচনের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে? যে সমাজ ব্যবস্থা আছে তাকে অক্ষুণ্ন রেখে আমি নির্বাচনে যেতে রাজি না। কারণ এ সমাজ ব্যবস্থার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে। এ সমাজ ব্যবস্থা না পাল্টালে নির্বাচন করে কী হবে? কিছুই পাল্টাবে না। আমি এ অবস্থায় নির্বাচন করব না। তাই নির্বাচন কমিশন আমাকে না ডেকে ভালোই করেছে।
এ সমাজ ব্যবস্থা পাল্টানোর কথা বললে আমার দলকে নিবন্ধন করতেন কি? আমি বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তাদের সঙ্গে আপনার মতের মিল আছে। প্রতিটি দল একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেছে। সেই শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে তারা ক্ষমতায় এসেছে। আপনারা 'নির্বাচন কমিশন', যাদের মনোনীত তাদের বাইরে আপনারা যেতে পারেন না। ভালো কথা বলে লাভ নেই। আজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধি বাতিল হয়েছে। একজন বিচারপতি এ আইন বাতিল করেছেন। এ বিচারপতিরা আগেও ছিলেন। কিন্তু আগে তারা পঞ্চম কিংবা সপ্তম সংশোধনী বাতিল করেননি। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকালে এ বিচারপতিরা মুখ খোলেননি। তারা মুখ খুললে এ জঘন্য ইতিহাস রচিত হতো না। কিন্তু হয়েছে। সুতরাং আপনারা নির্বাচন কমিশন নতুন কিছু নন। আপনাদের পেছনে একটি রাষ্ট্রীয় শক্তি আছে। তাদের একটি শ্রেণী-চরিত্র আছে। তাদের পেছনে বিদেশি শক্তি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সুতরাং আমি বলছি, আমাকে না ডেকে আপনারা ভালোই করেছেন। আমাকে ডাকলে আপনাদের আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হতো। কোন পরিস্থিতিতে ১/১১ এসেছিল, কী অবস্থায় এসেছিল? এক দল লাঠি-বৈঠা নিয়ে সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য মাঠে নেমেছিল। তারা বলেছিল, রাষ্ট্রপতির বাসভবন ঘেরাও করবে। তখন রাষ্ট্রপতির কী করার ছিল! তখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তাদের সেই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের পাহারাদার সেনাবাহিনী ডেকে আনা ছাড়া কী উপায় ছিল? আজকে কেউ বলছেন না_ কী পরিস্থিতিতে ১/১১ এসেছিল। তা বললে অনেক ইতিহাস বলতে হয়। আমি বিচারপতিদের অনুরোধ করব সব সময় একই আচরণ করার জন্য। তারা যদি শেখ সাহেবকে হত্যার বিচার করতেন তাহলে দেশে কোনোদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসত না। আজকে দেখছি রাস্তাঘাটে ঘটনা ঘটলে বিচারপতিরা নিজেদের উদ্যোগে আদালতে মামলা করেন। সুতরাং এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে দেশের মৌলিক অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন আমার কথা মানলে কমিশন থাকে না। কারণ যে সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে সে সরকার চায় না সমাজে মৌলিক পরিবর্তন হোক। তাই নির্বাচন কমিশন আমাকে না ডেকে ভালোই করেছে। তাহলে আজকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন কি? আপনাদের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন_ সব জায়গায় সঠিক হয়েছে কি? আপনারা সব জায়গায় সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন কি? জানি, আপনারা পারেননি। তবে আপনারা চেষ্টা করেছেন, সে জন্য ধন্যবাদ। এতদিনের নির্বাচনের ইতিহাস মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আপনারা শুরু করেছেন ভুল পথে। সমাজ ব্যবস্থা অটুট রেখে পরিবর্তন করা যায় না। আপনারা শেষ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ যে ব্যবস্থা ভাঙতে হবে সে ব্যবস্থা না ভেঙে আপনারা নির্বাচন করেছেন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবেন। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া এ কথা বলেছেন অনেক ক্ষোভে। প্রথমত, বর্তমান সরকার তার স্বামীর সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এ সরকার জিয়াউর রহমানের সংবিধান সংশোধন করেছে। সংবিধান সংশোধনের একটা আইনগত ব্যাখ্যা আছে। ইচ্ছা করলেই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া তার অন্যান্য ক্ষোভও আছে। তাকে বাড়িছাড়া করা হয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি আদালতের নির্দেশের পরে তার আর বাড়িতে থাকা উচিত হয়নি। তবে আমি মনে করি, তাকে উচ্ছেদ করা আরও শোভন হতে পারত। শত হলেও তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। আরও শোভনীয়ভাবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করলে লোকে বিষয়টাকে আলোচনায় আনত না। সবচেয়ে অন্যায় হয়েছে জিয়ার মৃত্যুর পর তাকে বাড়ি দেওয়া। প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে তিনি বাড়ি পেতে পারেন না। এ ছাড়া আছে বেগম জিয়ার পুত্রদের প্রশ্ন। তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এতে বেগম জিয়া মনে করতে পারেন, তার ছেলে বিধায় এ মামলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, তার ছেলেরা দোষ করেছে। তদন্ত হয়েছে। এখানে সরকারের কী করার আছে! এ বিষয়ে বেগম জিয়ার ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এ দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক মামলার তদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তন হয়ে যায়। সম্প্রতি আড়িয়ল বিল নিয়ে হাজার হাজার মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল। সেই বিক্ষোভে মামলা হয়েছিল। বেগম জিয়াকে সেই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছিল। যদিও সেই মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। আমার মনে হয়, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে এ মামলাটি করা সঠিক হয়নি। এর পরে সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ পিটিয়েছে। তার জন্য সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। তাও আবার পুলিশের নেতৃত্বে। এ ধরনের ছোটখাটো অনেক ঘটনা ঘটছে। বিএনপি মিছিল করলে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বিচার করা হয়। আমার জীবনে আমি অনেক মিছিল করেছি। কিন্তু মোবাইল কোর্টে বিচার করা হয়নি। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনায় বেগম জিয়া ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু শত ক্ষুব্ধতায় পড়েও আমি বলতাম না_ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেব। সংবিধান জাতীয় সংসদ তথা দেশের সম্পদ। সংসদে গিয়ে দেশের প্রয়োজনে তা সংশোধন বা বিয়োজন করা যায়। বেগম জিয়া একজন সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। অথচ তিনি সংসদে যান না। তার স্বামীর মতোই একতরফা ক্ষমতা দখল করার বাসনা নিয়ে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিতে চান। এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়? কে কী ভাবছেন জানি না। কিন্তু আমি ভাবছি, তাহলে কি দেশে আর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে? তা না হলে বেগম জিয়া এ কথা বলবেন কেন?

নির্মল সেন : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.