সংঘাতের পথে রাজনীতি!-হঠকারিতা নয়, সুবুদ্ধির পরিচয় দিন

ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরে আজ বিএনপির পূর্বঘোষিত মিছিল কর্মসূচি ছিল। গত ৯ জানুয়ারি রোডমার্চ শেষে চট্টগ্রামের জনসভায়ই এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতির কারণে জামায়াতও ঘোষণা করেছিল, তারাও মাঠেই থাকবে। এদিকে হঠাৎ করেই গত বৃহস্পতিবার পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মহানগর শাখা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে জনসভা আহ্বান করে।


ফলে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে আসা মিছিল মুখোমুখি হওয়ার এবং সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। এ অবস্থায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ঢাকা শহরে আজ সব ধরনের সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করেছে।
আওয়ামী লীগের হঠাৎ করে এ ধরনের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণাকে আমরা কোনোমতেই ভালো পদক্ষেপ হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি শাসক দলের যে ধরনের শ্রদ্ধাবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়, তার সঙ্গেও এটি মানানসই নয়। বরং এতে এক ধরনের অসহনশীলতাই প্রকাশ পাচ্ছে। এক দিন পরে বা আগে তারা সমাবেশটি করলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তাদের সদিচ্ছাই প্রকাশ পেত। আসলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আমাদের প্রধান দুটি দলেরই শ্রদ্ধাবোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। উভয় দলেরই কিছু নেতা-নেত্রীর কথাবার্তায় আমরা বিস্মিত হই। তাঁদের বক্তৃতায় পারস্পরিক বিষোদ্গার, কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞা এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাবই বরং বেশি করে প্রকাশ পায়। গঠনমূলক বা ইতিবাচক সমালোচনা নেই বললেই চলে। এটি কোনো দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশের পথে কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কিছু খোঁড়া যুক্তি দিয়ে প্রায় তিন বছর ধরেই সংসদ বর্জন করে আসছে। কেবল সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে সংসদ অধিবেশনে হাজিরা দিচ্ছে। সংসদ বর্জন করলেও শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিসহ সংসদ থেকে সব সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করছে। এটি কোনোভাবেই সৎ রাজনীতির পরিচয় বহন করে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতিতে সংসদকে অবজ্ঞা করার কিংবা একটার পর একটা অজুহাত দেখিয়ে ক্রমাগত সংসদ বর্জন করার কোনো সুযোগই নেই।
বাতিল করে দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধী দল দেশব্যাপী আন্দোলন করছে। কিন্তু চলতি অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি তাদের স্পষ্টতই আহ্বান জানিয়েছেন, 'আপনারা সংসদে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের প্রস্তাব দিন।' তারা কেন তা করছে না, কেন রাজপথে সমাধান খুঁজছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগই সংসদে সেই প্রস্তাব করুক, বিএনপি তাতে সমর্থন দেবে। এটিও বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে মাঠ গরম করার আরেকটি কৌশল মাত্র। কাজেই আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপির সংসদে যাওয়া উচিত এবং সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটির মীমাংসা হওয়া উচিত। রাজপথে সংঘাত করে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে আরো বেশি ছিল। যেখানে রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার বিএনপিকে সংসদে আসার আমন্ত্রণ জানান, সেখানে এই দলেরই কিছু নেতা ভেংচি কাটেন, কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করেন এবং বিএনপির ক্ষমতা নিয়ে এমনভাবে প্রশ্ন তোলেন যে রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারের সেই সৎ আহ্বানও তার প্রকৃত আবেদন হারিয়ে ফেলে। সাম্প্রতিককালে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান নিয়েও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বিএনপি সম্পর্কে এমন সব মন্তব্য করেছেন, যেগুলো মোটেও সুস্থ নয়। আর সেগুলো গণতান্ত্রিক রাজনীতি কিংবা সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি_কোনোটার জন্যই কাম্য নয়। বরং এ-জাতীয় বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছেন। দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার যে রয়েছে, তার অনেক আলামত আমরা পাচ্ছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘি্নত করার জন্য জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলো যে বসে নেই, তাও দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তারা গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বিনষ্ট করাসহ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অনেক অপচেষ্টাই করবে। সেটি মোকাবিলা করার জন্যই আজ সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা অপরিহার্য। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি প্রদান, অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন, গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে বাধা দান_এগুলো অন্ধকারের শক্তিকেই পথ করে দেবে।

No comments

Powered by Blogger.