আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫৯)-একাত্তরের সংলাপ by আলী যাকের

পূর্ব পাকিস্তানবাসীর পাকিস্তানবিমুখতা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং ক্রমেই আমরা এমন একটা জায়গায় পেঁৗছে যাচ্ছিলাম, যেখান থেকে ফিরে আসা দুষ্কর। ১৯৬৯ থেকে আপামর বাঙালি জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।


শেখ মুজিবের ওপর তাদের প্রত্যয় আরো দৃঢ় হলো এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে একটি ছাড়া বাকি সব আসনে জয়লাভ করল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এই জয়ের ফলে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পাকিস্তানিরা যদি গণতন্ত্রে সত্যিকার বিশ্বাস রাখত এবং প্রথাসিদ্ধভাবে রাজনীতির চর্চা করত, তাহলে শেখ মুজিবই হতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। পাকিস্তানিরা একজন বাঙালির শাসন মেনে নিতে কখনোই রাজি ছিল না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, কিন্তু তাদের আসনসংখ্যা ছিল আওয়ামী লীগের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬০টি আসনে নির্বাচিত হয় এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি নির্বাচিত হয় কেবল ৮১টি আসনে। আরো একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে এই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান যে সন্দেহাতীতভাবেই দুটি ভিন্ন দেশ তা-ও প্রমাণিত হয়। কেননা আওয়ামী লীগের পূর্ণ বিজয় ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয় কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে। যদি পকিস্তানের দুই অংশকে এক করে দেখা হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা শেখ মুজিবেরই। কিন্তু ভুট্টো বলেন, যদি তাঁকে ক্ষমতায় নেওয়া না হয়, তবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবেন। তৎকালীন প্রধান মার্শাল ল প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাই সেও শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাননি। অতএব শুরু হলো নানা প্রকার টালবাহানা। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উষ্ণ রাজনৈতিক হাওয়া বইতে শুরু করে। বাংলাদেশের ছাত্ররা মূলত এর নেতৃত্ব দেয়। তবে সাধারণ মানুষও পিছপা হয়নি। তাদের নিজস্ব রুটি-রুজির প্রয়োজনে যে কাজকর্ম, তার পরই তারা রাস্তায় নেমে আসত। উপস্থিত হতো মিটিং-মিছিলে, গলা মেলাত স্লোগানের সঙ্গে। এদিকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছিলেন যে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রেখে পাকিস্তানে বাঙালিদের শাসন কায়েম করা যায় কি না। মার্চ মাসের শুরু থেকেই পাকিস্তানিদের কূটচাল আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তারা নানাভাবে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার যে প্রক্রিয়া, তাতে বাদ সাধতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রস্তাব দেন, তিনি শিগগিরই জাতীয় অ্যাসেম্বলির অধিবেশন আহ্বান করবেন। অথচ ৩ মার্চ খবর এলো জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করা হয়েছে। সেদিন ঢাকায়, এখন যেটা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, সেখানে পাকিস্তান বনাম এমসিসি অথবা কমনওয়েলথ দলের একটা ক্রিকেট খেলা চলছিল। বাঙালি তো এমনিই ক্রিকেটপাগল। তাই রাজনৈতিক উদ্দামতা থাকা সত্ত্বেও ওই ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য তারা দলবেঁধে হাজির হয়ে গিয়েছিল স্টেডিয়ামে। জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিলের খবর স্টেডিয়ামে পৌঁছা মাত্র ক্রিকেট-বিনোদনে অবগাহনরত বাঙালি গর্জে উঠল। মুহুর্মুহু স্লোগান শোনা যেতে লাগল 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আর ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, জয় বাংলা...' ইত্যাদি। কয়েক মিনিটের মধ্যে স্টেডিয়ামের ওপরের শামিয়ানায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। দর্শকরা সব বেরিয়ে এলো স্টেডিয়াম থেকে। খেলাটি পণ্ড হয়ে গেল। ওই দিনই পল্টন ময়দানে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের এক বিশাল জনসভায় বাংলাদেশের লাল সূর্যখচিত সবুজ পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হলো। সে সময় মধ্যের লাল বৃত্তটির মাঝখানে হলুদে বাংলাদেশের মানচিত্রটি দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর মানচিত্রটিকে সরিয়ে ফেলা হয়। ওই দিন ছাত্ররা এও ঘোষণা করে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সঙ্গে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা আজ থেকে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত হব। এ ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল, তখন পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে শুরু হয়েছিল এক প্রাসাদ চক্রান্ত। এই চক্রান্তের মূল নায়ক ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসার এবং নাটেরগুরু ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ৩ মার্চেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন এক অসহযোগ আন্দোলনের। সেই আন্দোলনে আমরা দেখতে পাই যে বাংলাদেশ যেন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন হয়ে গেল। একটা সমান্তরাল সরকার চলতে লাগল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং তা চলতে লাগল বঙ্গবন্ধুর হুকুমে। অফিস-আদালত, কল-কারখানা, এমনকি ব্যাংকের কার্যক্রমও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী চলতে থাকে। বস্তুতপক্ষে তিনি ১৯৬৬ সালে যে ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন সেটারই যেন বাস্তবিক রূপ আমরা দেখতে পেলাম ওই সময় বাংলাদেশে। এ সময় পাকিস্তানিরা এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংলাপের ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই সংলাপ হয় জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। বঙ্গবন্ধু যদি বুঝতে পারতেন যে এই সংলাপটি হচ্ছে সময়ক্ষেপণের একটি পথ, তবু গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন শান্তিপূর্ণভাবে সব বিরোধের নিষ্পত্তি করতে। এই সংলাপ চলাকালীন আমরা সবাই প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন সংলাপস্থলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতাম। আশা যে হয়তো বাঙালির ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে শেষ পর্যন্ত। আমরা হয়তো স্বাধীনতার পথে একধাপ অগ্রসর হব। এই সংলাপের সময় সব বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছিলেন। তবে তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম_এঁরাই ছিলেন সর্বদা তাঁর দুই পাশে। সংলাপটি হতো বর্তমানে যেটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা নামে পরিচিত, সেই বাড়িটিতে।

(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.