সবাই আসুন 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনে by ইলিয়াস কাঞ্চন

কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, ভালো আছেন? বলতে হয়, ভালো আছি। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে ভালো নেই। প্রতি বছর শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে সচেতনতার অভাবে। এই অভাবটা আমাদের ভেতর যদি স্থায়ী হয় তাহলে কীভাবে ভালো থাকা যায়! সে জন্য টেনশন হয়। এই টেনশনের শুরুটা ১৯৯৩ সালে। ওই বছরের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় আমার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের। এরও আগে ১৯৮৮ সালে আমি নিজেই মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হই।
নিজের জীবনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এবং স্ত্রী বিয়োগের বেদনা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব পর্যন্ত 'নিরাপদ সড়ক চাই' শীর্ষক এক পদযাত্রায় শামিল হয়েছিলাম। সেদিন যারা সঙ্গী হয়েছিলেন এবং পরে আরও যাদের সমর্থন লাভ করি তাদের সাহসেই আজ শনিবার প্রতীকী অনশনের ঘোষণা দিয়েছি। এ আন্দোলনের জন্য আমার স্ত্রীর মৃত্যু একটা উপলক্ষ। এভাবে যেন আর কারও প্রিয়জন হারানোর বেদনার বোঝা বইতে না হয় সে জন্য নৈতিকতাবোধ থেকেই এ দায়িত্ব নিয়েছি। সম্প্রতি আরও একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। গত ১৩ আগস্ট তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যু আমাদের আন্দোলন আরও বেগবান করেছে।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমি অভিনয় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। পরে আমার ঘনিষ্ঠদের অনুরোধে মত পাল্টাই। সে সময় অনেককেই বলতে শুনেছি, 'ও এখন করছে স্ত্রীর শোকে কাতরে। ক'দিন পরেই এই শোক শেষ হয়ে যাবে।' এমন অনেক কথাই আমাকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি ছিলাম অবিচল। আমি কৃতজ্ঞ অনেকের কাছে, যারা 'নিরাপদ সড়ক চাই'র সঙ্গে এখনও আছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। আমাকে প্রশ্ন করা হয়, 'আপনি কি মনে করেন, চলচ্চিত্র অভিনেতা না হলে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতেন?' তাদের বলছি, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এমন আন্দোলনে কেউ এগিয়ে এলে অবশ্যই নিজেকে যুক্ত রাখতাম। কারণ, ১৯৮৮ সালে আমি নিজেও দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। তাই ভেতরে কিছু করার উপলব্ধি কাজ করছিল।
তারপরও মাঝেমধ্যে এ আন্দোলনে একা একা মনে হয়। আন্দোলনটা যখন শুরু করেছি তখন বিষয়টা আমার ছিল। কিন্তু এখন এটা আমার একার আন্দোলন নয়; এটা সামগ্রিক আন্দোলন। সুতরাং অনেকেই থাকবেন অনেকে এড়িয়ে যাবেন_ এটাই স্বাভাবিক। তারপরও আন্দোলনের কোথাও না কোথাও অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। শুরু থেকেই আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, সরকারি সহযোগিতা ঠিক ওই রকম অর্থে পাচ্ছি না। ধরুন গণসচেতনতার জন্য কিছু ডকুমেন্টারি, ছোট নাটিকা বানানো যায়। কিন্তু সেগুলো চালাবে কে বা সে জন্য অর্থের সংস্থানই-বা কোথায়? এ জন্য সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রচার ও প্রকাশনায় যদি সরকারের প্রকাশনা সেল সহযোগিতা করত, তাহলে আন্দোলন আরও বেগবান করা যেত।
আবার সরকারকে একতরফা দোষ দিলেও চলবে না। আমাদের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। যেমন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা কিংবা আমাদের প্রস্তাবনার সঙ্গে সমন্বয়হীনতা। আমরা বলছি পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কর্মঘণ্টা বেঁধে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয় সেদিকে পা বাড়াচ্ছে না। অথবা বলতে পারি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অবহেলার কথা। বিষয়টি লক্ষ্য করলে দেখবেন, এ আন্দোলন তাদেরই প্রথম করার কথা। কিন্তু কেন তারা সেটা করছেন না? আমার 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু অর্থ জোগানদাতা কে হবে? সবকিছুর পর আমাদের মনে রাখতে হবে, কে এড়িয়ে গেল না গেল তাতে কিছু আসে যায় না। মূল বিষয়টা হচ্ছে_ সড়ক নিরাপত্তা কেবল আমার দাবি নয়, এটা এখন সবার দাবি। আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার জন্য চাই রাজনৈতিক সহযোগিতা।
সবশেষে বলতে চাই, আজকের ইলিয়াস কাঞ্চনকে সুপারস্টার বানিয়েছে ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া 'বেদের মেয়ে জোছনা' চলচ্চিত্রটি। আজকের এই কাঞ্চনকে দর্শক-শ্রোতারা চেনে বেদের মেয়ে জোছনার ইলিয়াস কাঞ্চন হিসেবে। বলতে পারেন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, ইলিয়াস কাঞ্চন মিলে কৃতজ্ঞ বেদের মেয়ে জোছনার কাছে।

ইলিয়াস কাঞ্চন :চিত্রনায়ক

No comments

Powered by Blogger.