আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস-প্রবাসী শ্রমিকের স্বীকৃতি by তাসনিম সিদ্দিকী

জাতীয় অর্থনীতিতে অভিবাসী কর্মীদের অনন্য অবদানের পরও অভিবাসন প্রশাসন এখনো বেশ জটিল অবস্থায় আছে। গন্তব্য দেশগুলোতে অভিবাসীদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আছে বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয়। এর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট, উপসাগরীয় অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধাক্কা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সামাজিক প্রতিক্রিয়াসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জ।


শ্রম অভিবাসন ও রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭০-এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ দশমিক ১ মিলিয়ন লোক মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অভিবাসন করেছে। তাঁদের আয় এবং পাঠানো রেমিট্যান্স লাখ লাখ পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ২০১০ সালে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসীরা ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। এটি গার্মেন্টস খাত থেকে পাওয়া বৈদেশিক আয়ের তিন গুণ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ১২ গুণ এবং বাংলাদেশের পাওয়া বৈদেশিক সাহায্যের ছয় গুণেরও বেশি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার অভিবাসীদের সমস্যা ও দুর্ভোগ নিরসনে বিভিন্ন ধরনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য সরকার বাধ্যতামূলক অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করেছে। অভিবাসন ব্যয় নির্বাহের জন্য অভিবাসনে ইচ্ছুক কর্মীদের জমিজমা বিক্রি রোধ করতে সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের প্রশ্নে সরকারের অবস্থান সমুন্নত করতে সরকার ১৯৯০ সালের ‘ইউএন কনভেনশন অন রাইটস অব অল মাইগ্রেন্টস ওয়ার্কারস অ্যান্ড মেম্বার অব দিয়্যার ফ্যামিলিস’ বিনা রিজারভেশনে অনুমোদন করেছে। তার পরও অভিবাসন ব্যবস্থাপনা এবং অভিবাসনে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক সমস্যা বিদ্যমান।
২০১০ সালের অভিবাসন এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত বিশ্ব ফোরাম (জিএফএমডি) এবং ২০১০ সালের আইওএমের বিশ্ব রিপোর্টে অভিবাসী গ্রহণকারী এবং প্রেরণকারী দেশগুলোর অভিবাসন-ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত সামর্থ্য বৃদ্ধি মূল দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তারা বর্তমান কাঠামোর মূল সামর্থ্যগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে এর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণের উপর জোর দিয়েছে। অভিবাসন-ব্যবস্থাপনার জটিলতা অনুধাবন করে তারা বিশ্ব অভিবাসন পটভূমির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সামর্থ্য বিনির্মাণকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সামর্থ্য বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, ব্যাংক ও নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-সংক্রান্ত পরামর্শ সংস্থা ও সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় জড়িত খাতগুলোর দক্ষতা বিনির্মাণ বিচ্ছিন্নভাবে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসন্ন পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও দশ বছর মেয়াদি কাঠামোগত পরিকল্পনায় দক্ষতা বিনির্মাণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বের ১১টি উদীয়মান অর্থনৈতিক একটি অতীব সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে। তিনটি খাত বাংলাদেশকে এ অনন্য সম্মানের জায়গায় তুলে এনেছে। এগুলো হলো—তৈরি পোশাকশিল্প, সেবা খাত এবং অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, যেসব এলাকা থেকে বেশি লোক কজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন, সেসব এলাকায় দারিদ্র্য কমেছে বেশি। দারিদ্র্য নিরসনে অভিবাসনের এই গুরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে সমুন্নত করতে ২০১২-২০২১ দশককে ‘অভিবাসন দশক’ হিসেবে ঘোষণার সুারিশ করছি। এ জন্য প্রয়োজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অব্যাহত সুদৃষ্টি।
এ বছর সরকার অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ প্রণীত ১৯৯০ ইউএন কনভেনশন অনুমোদন করায় আমরা গর্ব বোধ করছি। এখন এই আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাদেশগুলো জাতীয় আইন ও কর্মপদ্ধতিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সরকারকেই দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন সময়, সম্পদ ও দক্ষতা। অভিবাসন দশক ঘোষণা বিদ্যমান আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক জ্ঞানসহ শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোকে তাদের অর্থনীতিতে আমাদের অভিবাসী শ্রমিকেরা যে অবদান রেখে চলেছেন, তা বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আঞ্চলিক উদ্যোগ যেমন-কলম্বো প্রসেস, আবুধাবি ফোরাম এমনকি জিএফএমডি এবং গ্লোবাল মাইগ্রেশন গ্রুপের মতো বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোকে যথাযথ প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে এবং অভিবাসন দশক ঘোষণা এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃহদাকার উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ জোগানের উৎস হিসেবে যে অমিত সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে, তা কাজে লাগাতে হবে। যদি অভিবাসীদের প্রণোদনা দেওয়া যায়, তাহলে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পে তাঁদের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা অসম্ভব কোনো প্রস্তাবনা নয়। অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তরিত করতে ২০১২-২০২১ দশককে অভিবাসন দশক ঘোষণা জরুরি।
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বিদেশ থেকে প্রত্যাগত শ্রমিকদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পরবর্তী পাঁচ বছরব্যাপী সমন্বিত প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যাতে করে জাতীয় পর্যায়ে সব প্রত্যাগত অভিবাসীর তথ্য সংগ্রহ করে তাঁদের চাকরি এবং বিনিয়োগ স্কিমের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
২০১২-২০২১ দশককে অভিবাসন দশক হিসেবে ঘোষণা করা নিঃসন্দেহে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলার অবকাঠামোগত এবং নীতি প্রণয়ন ও সেবা প্রদানের সামর্থ্যের উন্নয়ন ঘটাবে। শ্রম অভিবাসনকে অভিবাসী, তাঁদের পরিবার এবং জাতির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে এটি দেশের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।
অভিবাসন দশক ঘোষণা শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দানে সজাগ করবে। পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১০ বছর খুবই যৌক্তিক সময়সীমা।
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চেয়ারপারসন, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট— রামরু।

No comments

Powered by Blogger.