চারদিক-‘বাবার চোখে যুদ্ধ লেগে আছে’

মাদের বাবা প্রচারবিমুখ সাহসী, দৃঢ়চেতা স্পষ্টভাষী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নাম বললেই আপনারা চিনে যাবেন, যাঁকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-পরিজন সবাই ’কমল’ নামে চেনে। হ্যাঁ, কমল সিদ্দিকী বীর উত্তম; যদিও বাবার পোশাকি নাম একটা আছে। সেই নাম মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী। এই নাম শুধু সরকারি কাগজপত্রে ও পাসপোর্টে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। আমাদের দুই বোনের জন্য আরও বেশি গৌরবের।


ডিসেম্বর মাস এলেই খবরের কাগজ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের কথা, গল্প, নাটক ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনকাহিনি দেখতে পাই। আমরা এই প্রজন্মের সন্তান। এই প্রজন্মের অনেকের মতো আমাদেরও মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু মনে পড়ছে মা-বাবার কাছ থেকে শোনা বাস্তব অনেক গল্প, অনেক কাহিনি। আজকের দিনে আরও একটি কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আমাদের প্রয়াত নানাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনিও ছিলেন প্রচারবিমুখ। মায়ের কাছ থেকে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। স্বাধীনতার এই ৪০ বছর উদ্যাপনে তাঁকেও আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
মায়ের কাছে শুনেছি, ছোট বেলায় আমরা দুই বোন নাকি প্রায়ই বলতাম, ‘বাবার চোখে যুদ্ধ লেগে আছে।’ হ্যাঁ, আমাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ডান চোখ হারিয়েছেন। বাবার তাতে কোনো দুঃখ বা ক্ষোভ নেই বরং বাবা গর্বভরে বলেন ‘আমার কত বড় সৌভাগ্য, সৃষ্টিকর্তা আমাকে এত সুযোগ দিয়েছিলেন যে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে শরিক হতে পেরেছি।’
বাবার বন্ধুরা বাবাকে নিয়ে গর্বিত। আত্মীয়-স্বজনেরাও গর্বিত বাবাকে নিয়ে। আমরা তাঁর আলোয় আলোকিত। সেই যে বাবাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান ‘কমলের চোখ’।
বাবার কাছে আরও শুনেছি, বাবার সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা (খন্দকার নাজমুল হুদা, বীর বিক্রম, পরে কর্নেল, ১৯৭৫ সালে নিহত) আংকেল যত দিন বেঁচে ছিলেন তিনি ১৫ ডিসেম্বর ভোরবেলা বাবাকে ফোন করে বলতেন ‘কমল, আজকেই তোমার শেষ দিন যে দিন তুমি দুই চোখ দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু দেখছ; তারপর ...... ।’
বাবা ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাবসেক্টরের যোদ্ধা ছিলেন। হ্যাঁ, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার ভাটিয়াপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে বাবার ডান চোখ ও মাথার খুলির একাংশ উড়ে যায়। গোপালগঞ্জ জেলার উত্তর দিকে এবং কাশিয়ানী থানার দক্ষিণ-পশ্চিমে মধুমতী নদীর পারে ভাটিয়াপাড়া। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর ৮ নম্বর সেক্টরের অধিকাংশ এলাকা ১২-১৩ ডিসেম্বরের মধ্যেই মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ভাটিয়াপাড়া তখনো মুক্ত হয়নি। সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি। এই সময় শত শত মুক্তিযোদ্ধা ভাটিয়াপাড়া ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলে। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়। তখন হুদা আংকেল ও আব্বু যশোর থেকে এসে ভাটিয়াপাড়ায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন। কয়েক দিন সেখানে যুদ্ধ হয়। ১৫ ডিসেম্বর গোলাগুলির সময় হঠাৎ আব্বুর চোখে গুলি লাগে। সেই সময় আব্বু ও হুদা আংকেল গাছের আড়ালে চা খাচ্ছিলেন। নীলু আন্টি (হুদা আংকেলের স্ত্রী, নীলুফার হুদা) তাঁর বইয়ে (কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১১) আব্বার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...কমল সিদ্দিকীও আমাদের বাসায় এসেছেন। কমল সিদ্দিকীর প্রকৃত নাম মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী, প্রকৌশলী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে কাজ করেছেন। কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন।...যুদ্ধের একদম শেষ দিকে সম্ভবত ১৫ ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়ায় কমল সিদ্দিকীর চোখে গুলি লাগল। সেই সময় হুদা ও কমল ওখানে গাছের গুঁড়ির আড়ালে ছিলেন। সকাল আটটার দিকে তাঁরা দুজন চা খাচ্ছিলেন। এমন সময় কমলের চোখে গুলি লাগে। এরপর তাঁকে মুক্ত যশোরে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কলকাতায় নেওয়া হয়। কমল আমাকে মাঝেমধ্যে চিঠি লিখতেন। ওঁর অনেক চিঠি আমার কাছে আছে। কমলের চিঠিতে আছে, স্যার (অর্থাৎ হুদা) আমাকে নিচ্ছেন না, এ জন্য ওঁর অনেক কষ্ট। তিনি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে ছিলেন। কমল সিদ্দিকীকেও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সংস্থাপন বিভাগে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তৌফিক (তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী) ও মাহবুব (মাহবুব উদ্দীন আহমেদ)দের মতো সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।’
সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণা, বাবা সুস্থ-সবল আছেন। বাবার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অরণি সিদ্দিকী ও অদিতি সিদ্দিকী

No comments

Powered by Blogger.