মুক্তিযুদ্ধ-পাকিস্তানের শাসকদের মূঢ়তা ও বাংলাদেশের ভরসা by এ আই রহমান

যে সময়টায় বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল, সেসব দিনের স্মৃতি আমার মধ্যে তৃপ্তির বোধ জাগায়—এ জন্য যে, লাখো-কোটি মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের সেই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের সুফল ফলেছে। একই সঙ্গে অনুতাপ ও লজ্জার অনুভূতিও হয়। কারণ, আমাদের ক্ষীণদৃষ্টির শাসকেরা তাদের মূঢ়তা ও অপরাধের ব্যাপকতা কখনো উপলব্ধি করতে পারেনি; এমনকি যে যুদ্ধ আদতে শুরু হওয়াই উচিত ছিল না, সেই যুদ্ধের পরাজয়ের দিনেও তারা মূঢ়তাই দেখিয়েছে।


আজ পাকিস্তানিদের বড় একটি অংশ অনুতপ্ত যে, তারা সে সময় বাঙালিদের স্বাধীনতার আকুতিকে সঠিক দৃষ্টিতে দেখতে পারেনি। তারা হয়তো সঠিক, কিন্তু তারা বলতে পারবে না, কী ঘটছে সেটা তাদের কেউ বলে দেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের সমগ্র জনগোষ্ঠীই বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ সমর্থন করেনি। নিজেদের ভাগ্যের মালিক হওয়ার যে বাসনা বাঙালিদের তাড়িত করেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, বিশেষত বালুচ, পখতুন ও সিন্ধি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন মাত্রায় তা বুঝেছিল অথবা তার অংশীদার হয়েছিল। এসব দলের নেতারা ঢাকায় যেতেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করতেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান, তাঁর পারিষদ ও সহযোগীদের কূটচাল মোকাবিলায় তাঁরা অসহায় ছিলেন। অবশ্য নাগরিকদের ছোট একটি অংশ গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ন্যায্যতা ও শক্তি অনুধাবন এবং মূল্যায়ন করতে পারছিল।
আমিও সাংবাদিকদের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলাম এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাংবাদিক বন্ধুদের মারফত বাঙালি জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন একটা ধারণা গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা দায়বদ্ধ বামপন্থী হিসেবে বিবেচিত হতেন এবং তাঁরা সকল জাতির স্বশাসনের অধিকারের পক্ষ নিতেন। আমার বাড়তি সুবিধা হলো, কয়েকজন চলচ্চিত্রনির্মাতাকে আমি জানতাম। তাঁদের কেউ কেউ কেবল রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিই ছিলেন না, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িতও ছিলেন। ১৯৬৪-১৯৭০ পর্যন্ত ঢাকায় নিয়মিত সফরকারী হিসেবে আমি স্বাধীনতা আন্দোলনের গড়ে ওঠাটা দেখতে পাই, বিশেষত ১৯৬৮-৬৯ সালে। সে সময়ের কিছু ঘটনা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে, যেমন:
চলচ্চিত্রনির্মাতা, অভিনেতা ও সুরকার খান আতাউর রহমান আমাকে একা নৈশভোজের দাওয়াত দিয়ে বললেন, ‘রাজনীতি ছাড়া যেকোনো আলাপ আমি তুলতে পারি। কারণ, ছয় দফা নিয়ে আপস সম্ভব নয়।’
আইয়ুব খানের ঢাকা আগমনের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। সে সময় তাঁকে প্রত্যাখ্যানকারী সাধারণ মানুষের মুখে ঘৃণা ও ক্রোধের ছাপ পড়তে না পারা অসম্ভব ছিল।
চলচ্চিত্রনির্মাতা মুস্তাফিজের কিশোর বয়সী ছেলে আমাকে যখন লাহোর বা ইসলামাবাদের শিশুরা কত ভালো ভালো জিনিস উপভোগ করতে পারে, অথচ সেসব সে বা ঢাকার অন্য শিশুদের করতে দেওয়া হয় না বলে ক্ষোভ জানাল, তখনই বাঙালিদের বিচ্ছিন্নতার মাত্রাটা পরিমাপ করতে পারলাম।
পল্টন ময়দানে মাওলানা ফরিদ আহমেদের সভা যখন তরুণেরা পণ্ড করে এবং তাঁকে তাড়া করে, তখন আমি ঢাকায়।
১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে, হোটেলের জানালা দিয়ে আমি তরুণদের একটি মিছিল যেতে দেখলাম। যে-কেউই পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ এবং ইসলামাবাদের প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়া খেয়াল করতে পারত। বুঝতেও পারত, ছাত্ররাই মোটামুটি আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে তাদের অস্বীকার করা ছিল অসম্ভব।
মনের পর্দায় ১৯৭০-৭১-এর কিছু স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে: ১৯৭০ সালের এপ্রিলে সাংবাদিকেরা দেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করে এবং তা সফলও হয়, যদিও শতাধিক সাংবাদিক, লিখনশিল্পী এবং প্রেস কর্মচারী ছাঁটাই হয়। এ টি চৌধুরী, আবদুল্লাহ মালিক, হামিদ আখতার, আব্বাস আতহার, মিনহাজ বার্না এবং আমিও বরখাস্ত হই। এরপর ইউনিয়নের নির্দেশনা মোতাবেক আবদুল্লাহ মালিক, হামিদ আখতার, আব্বাস আতহার এবং আমি মিলে সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে দৈনিক আজাদ (ঢাকার নয়) প্রকাশ করে ইয়াহিয়া চক্রকে জবাব দিই। নির্বাচনের এক দিন আগে আমরা আভাস দিই, দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করবেন তিনজন ব্যক্তি—শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং খান আবদুল ওয়ালি খান। সে সময়ের একটি শিরোনাম ছিল: ‘গণরায় সবাই না মানলে জাতীয় পরিষদ ফাঁকা হয়ে যাবে এবং বিষয়টার মীমাংসা হবে রাজপথে’। আমরা এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা ১৬২ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জিতবে ১৪০টিতে। (অবশ্য দুটি ছাড়া সব আসনই তারা পেয়েছিল)।
মাজহার আলী খান ছিলেন সম্পাদকদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, বাঙালিদের প্রতি সংহতির জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি আমাদের পত্রিকায় তাঁর কলামগুলো ছাপানোর অনুমতি দিলেন, এর মধ্যে ঢাকা থেকে ড. কামাল হোসেন ও রেহমান সোবহান প্রকাশিত ফোরাম পত্রিকার লেখাগুলোও ছিল।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানকে আমাদের গ্রুপ স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশের চূড়ান্ত যাত্রার সূচনা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মে ১৯৭১-এ আজাদ-এর অন্যতম সম্পাদক আবদুল্লাহ মালিককে সামরিক আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দেন। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন এবং এর জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন।
এয়ার মার্শাল নূর খান পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরের পদ ত্যাগ করে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি আজাদ-এর জনপ্রিয়তা দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। আমি এবং তাঁর তরুণ উপদেষ্টাদের অন্যতম আহসান রশিদ তাঁর সঙ্গে ঝিলমে গিয়ে একটি ছাপাখানার অর্ডার দিই। পথে আমি নূর খানের কাছে বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই। ‘মনে হচ্ছে, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধের পরাজয়ের খেসারত হিসেবে হারাতে যাচ্ছে’, তিনি বললেন। আহসান গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর আমাদের মধ্যে নেমে এসেছিল পূর্ণ নীরবতা। নূর খানের সেই প্রেসেই ৫০-৬০ জন বাঙারিদের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের প্রতিবাদে জমায়েত হতো।
লাহোর ও ইসলামাবাদের রাজনীতিবিদদের আচরণ আমাদের হতাশ করত। এক ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদ ভারতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সম্পত্তি দখল করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন।
জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের সদস্যদের শূন্যপদে উপনির্বাচনের ঘোষণা অনেকের কাছেই মনে হলো এমন এক সিদ্ধান্ত, যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
ভুট্টোর দলের লোকেরা ঢাকা সফর করলেন বটে, কিন্তু লাহোরে ফিরে তাঁদের কথা শুনে মনে হলো, কী ঘটছে তা বুঝতে তাঁরা অক্ষম।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ‘ঢাকা পতনের’ জন্য আহাজারি করে তাদের ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করল। অথচ যে বাঙালিরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তাদের থেকে অনেক বড় অবদান রেখেছিল, তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্যাপকভাবে নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য কোনো অনুশোচনা তাদের মনে জাগল না।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দেখার এবং নতুন রাষ্ট্রের কার্যক্রমে এর প্রভাব নিরূপণ করার বেশ কিছু দৃষ্টিকোণ রয়েছে। সত্যি, বাঙালি জাতি, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং সরকারি পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে তাদের ন্যায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া নিয়ে ক্রুদ্ধ ছিল। কিন্তু গোড়ায় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ বাঙালি নাগরিকেরা তাদের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতির লড়াই শুরু করে। তারা মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি এবং উত্তর থেকে আসা তাদের উত্তরসূরিদের কাছেও তারা মাথা নত করেনি।
বাঙালি পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছে, কিন্তু এর জন্য তাদের রক্ত দিতে হয়নি, অন্তত যেভাবে তারা বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছিল, সেভাবে নয়। ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় মুক্তির জন্য সত্যিকার একটি যুদ্ধ শুরু করেছিল, যা থেকে তাদের মনে জন্ম নিয়েছিল নিজ রাষ্ট্রের প্রতি এমন এক মালিকানাবোধ, যা তারা আগে কখনো উপভোগ করেনি। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগ থেকে একই রকম পরিণত রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টি হয়নি। তাদের একদিকে স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, অন্যদিকে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের উচ্চাভিলাষ মোকাবিলা করতে হয়েছে।
তবু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সে দেশের সক্ষম নাগরিকদের পুরো প্রজন্মকেই অনুপ্রাণিত করেছে; বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান একদা আমাকে যেমন বলেছিলেন, তাদের স্বপ্ন হলো সরকারি দপ্তরের কুশনশোভিত আসনে বসা। বাংলাদেশকে উর্দি পরিহিত সুযোগসন্ধানী এবং তুখোড় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপন্থীদের কারণে বাঙালিরা যথেষ্ট ভুগেছে। এই দুই গোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশ জাগরণের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং সেই চেতনা বহন করে সে দেশের নারীরা, যারা পোশাকশিল্পে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আনছে, সে দেশের বিদ্বানরা যারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছে, এবং ড. মুহাম্মদ উনূস, ফজলে হাসান আবেদ ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষেরা।
কোনো দেশেরই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে স্থায়ী নিশ্চয়তা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশের নির্মাতাদের রক্তদান থেকে এমন এক ভরসা সৃষ্টি হওয়া উচিত, শাসকদের এই বা সেই অংশের দ্বারা রাষ্ট্র বিপথে চললেও যার কল্যাণে তারা আবার সঠিক পথে আসতে সক্ষম হবে। অন্তত পক্ষে যে দেশে এমন অনেক নারী ও পুরুষ আছেন, যাঁরা জানেন যে নিরন্তর নজরদারি ও সচেষ্টতার মূল্যেই স্বাধীনতা রক্ষিত হয় এবং যাঁদের আছে নিজেদের বিশ্বাসের সৎসাহস।
এ আই রহমান: পাকিস্তানি সাংবাদিক, যিনি একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.