চারুশিল্প-ছবি-পাঠ by সিলভিয়া নাজনীন

বিকে নিবিড় পাঠের আওতায় অনুভব করতে হয়। ছবির বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় থাকলে অতি সহজেই অন্দরে প্রবেশের চাবি চলে আসে শিল্পানুরাগীর হাতে। রং-রেখা, আকার-আকৃতি-বিন্যাসের এই নান্দনিক জগতে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান দার্শনিকতায় ঋদ্ধ একজন শিল্পী। শুধু চোখ দিয়ে দেখেই শেষ হয় না, ওয়াকিলের কাজকে পাঠ করতে হয়।


ধ্বনি-শব্দ-বর্ণ এবং শ্রুতি ও দৃষ্টির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘যখন একটা কনটেক্সটে ছবি দেখি, তখন এর আগে-পরে অনেক ব্যাপার আছে, যা জানতে হবে। সুতরাং এখন তো ছবি পড়ার ব্যাপার আছে। যেমন আমি যখন ১৯৭১ সাল লিখি একটা ক্যানভাসে, এটা এমনভাবেই লিখলাম যেন তা আর্টের মর্যাদা পায়। খুব সহজেই একজন বাঙালি বুঝতে পারবে এর কনটেক্সট। তারা এটা অনুভব করতে পারে। সংখ্যা ও ফর্ম—দুটোই বুঝতে পারবে। তবে একজন বিদেশির কাছে এটা শুধুই ডিজাইন। তার মানে, যেকোনো কনটেক্সটে একটি ছবি বিভিন্ন অর্থে প্রকাশিত হয়। আর্ট এখন কনটেক্সটে দেখতে হবে বা দেখা উচিত। আগে বলা হতো, আর্টের ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারন্যাশনাল। তবে একটা গণেশের মূর্তি তার ধর্মের লোকের কাছে যে অর্থ বহন করে, একজন পশ্চিমা লোকের কাছে একই অর্থ বহন করে না।
ওয়াকিলের কাজে চিন্তার ধারাবাহিক একটা রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী একধরনের সমগ্রতা ধারণ করে; অনেকটা কবিতার সমগ্রের মতো। শিল্পীর ক্রমবিবর্তনকে তাই সহজেই বুঝে নিতে পারে অনুরাগী দর্শক। বইয়ের আকৃতি ও অক্ষরের নিবিড় পর্যবেক্ষণ তাঁর চিত্রকর্মকে আমূল বদলে দিয়েছে। তিনি মূলত ছবি লিখতে পছন্দ করেন এবং দর্শককে তিনি পাঠকে রূপান্তরিত করেন। প্রোডাক্টের থেকে আইডিয়াকে তিনি গুরুত্ব দিতে পছন্দ করেন। তাঁর কাজে আইডিয়ার প্রসেসটাও দীর্ঘ। যদিও আইডিয়ার নতুনত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। পুরোনো প্রতিষ্ঠিত বিষয়ের মোড়ক বদলে উপস্থাপন করার কৃতিত্ব শিল্পীর রয়েছে। তাঁর দীর্ঘদিনের কাজে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি দর্শকের জন্য ক্লান্তিকর।
চোখ ও কানকে একই সঙ্গে সজাগ করে তোলে ওয়াকিলের কাজ। শিল্পকর্মের অংশ হয়ে যাওয়া টেক্সটগুলো কোথাও কোথাও মুখ তুলে কথা বলে দর্শকের সঙ্গে; কোথাও গভীর ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে থাকে; শিহরিত দর্শক অতি সহজেই ছেড়ে যেতে পারে না তাকে। এ প্রসঙ্গে ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘ভিজ্যুয়াল আইডেনটিটির এলিমেন্ট হিসেবে যা পরিচিত, তা নিয়ে আমরা ভেবেছি। এটা পিকটোরিয়াল আইডেনটিটির একটা অংশ। এর একটা ট্র্যাডিশন রয়েছে। তাই এই শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আইডেনটিটি খোঁজার ব্যাপার আছে। আমি যখন বাতাস শব্দটা লিখি, তখন আমার কনসাসনেস আছে। আমার আর্ট অনেক লোকাল। আমি জানি, এই অঞ্চলের মানুষ এটা এনজয় করতে পারবে। শব্দ আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। অপ্রাপ্ত বয়সে যখন প্রাপ্ত বয়সের বই পড়েছি, তখন বুঝেছি শব্দের কী ক্ষমতা। শব্দের পিকটোরিয়াল আবেদন আছে, আবার সেই শব্দ যদি পরিচিত হয় তা নতুন ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। আকৃতি, ইতিহাস নিয়ে একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে আমি যাই।’
ওয়াকিলের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতে টেক্সট প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিছু শব্দ, লাইন, বাংলা অক্ষর—এসব তাঁর পেইন্টিংয়ের আত্মা হিসেবে বিরাজ করে। তাঁর পেইন্টিংয়ে অক্ষরগুলো সু্কলের লাইন টানা বাংলা খাতার ভেতর থেকে উঠে আসে অধিকাংশ সময়। সবকিছুতেই তিনি দেখতে পান বর্ণমালার খেলা। প্রকৃতিকে তিনি অক্ষরের মতো পাঠ করেন এবং ক্যানভাসে তুলে আনেন দর্শকের জন্য।
গুলশানের বেঙ্গল লাউঞ্জে সম্প্রতি শুরু হয়েছে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের ‘ছবি-পাঠ’ শীর্ষক একক প্রদর্শনী। ১৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত।

শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান: জন্ম ১৯৬১ সালে, ঢাকায়। তিনি ১৯৮১ সালে চারু ও কারুকলা কলেজ (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে বেইজিং সেন্ট্রাল একাডেমি থেকে ১৯৮৬ সালে এমএফএ শেষ করেন। তিনি দেশে-বিদেশে একক ও যৌথ প্রদর্শনী করেছেন এবং বহু পুরস্কার পেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.