উত্তর প্রদেশের নির্বাচন এবং পেশিশক্তির বিরুদ্ধে আমির খানের লড়াই-ভারত by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

উপিএ নির্বাচনে চিত্রতারকা আমির খানও নেমে পড়েছেন। না, তিনি ভোটে প্রার্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছেন না। আমিরের একটি সংস্থা আছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিআর)। তিনি ইউপিএর ৪ লাখ ও উত্তরা খণ্ডের ১ লাখ, পাঞ্জাবের ১ লাখ মানুষের উপযোগী একটি অভিনব পরিসেবা উপহার দিচ্ছেন।


যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিশেষ প্রার্থী সম্পর্কে জানতে চান লোকটা কেমন, তার বিরুদ্ধে অপরাধের ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে কি-না, তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারবেন

উত্তর প্রদেশসহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে ভারতের রাজনীতি এখন সরগরম। এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে পড়েছে ইউপি, উত্তরা খণ্ড, পাঞ্জাব, গোয়া ও মণিপুর। উত্তর প্রদেশের নির্বাচন এর মধ্যে একাই একশ'। কারণ এই রাজ্য থেকেই নাকি সর্বভারতীয রাজনীতির ড্রেস রিহার্সাল শুরু হয়। তাই সব রাজনৈতিক দলেরই চোখ এখন উত্তর প্রদেশে। উত্তর প্রদেশ যেন ভারতের ওয়াটারলু। এখানে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিকে হারিয়ে কংগ্রেস ও মুলায়ম সিং যাদবের দল যদি সরকার গড়ে ফেলতে পারে, তাহলে কেন্দ্রে ক্ষমতার এক নতুন সমীকরণ ঘটবে। নির্বাচন শুরু ৩০ জানুয়ারি।
মুলায়ম সিংয়ের সমাজবাদী দল বা এসপি কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারে নেই। কিন্তু কংগ্রেস ইউপিএ বিধানসভায় এবার সিট বাড়িয়ে নিতে পারলে বিএসপির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিএসপিও কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করতে পারে। এখন মনমোহনের সরকারকে আর তৃণমূলের সমর্থনের ওপর পদে পদে নির্ভর না করলেও চলবে। লোকসভায় তৃণমূলের ১৯ জন সাংসদ। তার জোরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদে পদে ইউপিএ সরকারের বিরোধিতা করছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি, খুচরা বাজারে বিদেশি লগি্ন থেকে শেষমেশ লোকপাল বিল, ইউপিএ সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বাধা দিয়েছেন মমতা। এর জন্য মনমোহন সিংকে অপদস্থ হতে হয়েছে পদে পদে। বিশেষ করে ঢাকার কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও মমতা বেঁকে বসায় শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারেনি। দেখা যাচ্ছে, প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে কংগ্রেসের জোটসঙ্গী সিপিএম শুধু আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, আর কিছুতে বাধা দেয়নি। তাতেই সেবার সরকার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন মুলায়মের এসপি দল মনমোহন সরকারকে সমর্থন করে বলে সরকার পতনের হাত থেকে বাঁচে। তবে অভিযোগ ওঠে, সমাজবাদী পার্টির তখনকার সেক্রেটারি অমর সিংহ নাকি প্রচুর টাকা দিয়ে সরকার পক্ষে ভোট কিনেছিলেন। এই অভিযোগে অমর সিংহ গ্রেফতার হন। সেই মামলা এখনও চলছে। তবে অমর সিংহ এখন আর সমাজবাদী দলের সঙ্গে নেই। সংসদে সমাজবাদী দলের ২২টি আসন। কংগ্রেসের একটা অংশ মনে করে, মুলায়ম সিং যাদবকে সঙ্গে পেলে ইউপিএ সরকারকে আর তৃণমূলের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। শেষ দুটি বছর কেন্দ্রীয় সরকারের ভালোয় ভালোয় কাটাবে। তবে উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে কংগ্রেস এখনও একাই লড়ছে। উত্তর প্রদেশে ভোট হয় জাতপাতের ভিত্তিতে। ভারতের এটাই একমাত্র রাজ্য, যেখানে অনগ্রসর, দলিত সংখ্যালঘু ও অন্যান্য পেছনের সারির উপজাতি মিলিয়ে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি তথাকথিত উঁচু জাত মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ। তাই এই রাজ্যে ভোটও হয় জাতপাতের ভিত্তিতে। বহু ক্ষেত্রে এক জাতের প্রার্থীকে অন্য জাত ভোট দেয় না, তা সে তার দলের লোক হলেও।
মায়াবতী ও তার গুরু কাসিরাম (বহুজন সমাজ পার্টি) মিলে বহুজন সমাজ পার্টি তৈরি করেন। তারা দু'জনই দলিত (তফসিলিভুক্তদের মধ্যেও যারা সবচেয়ে পিছিয়ে ও বর্ণ হিন্দুদের কাছে একদা 'অস্পৃশ্য' বলে পরিচিত তারাই দলিত। যেমন 'চণ্ডাল')। মায়াবতী তাদের নেতা। তার নেতৃত্বে দলিতদের ক্ষমতায়ন ঘটেছে। তারাই রাজনীতির ক্ষেত্রে ও বহু ক্ষেত্রে সমাজজীবনে উচ্চবর্ণের সমমর্যাদা পেয়েছেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, দলিতদের মধ্যেও অনেক জাত। হিন্দু দলিতদের ক্ষমতায়ন ঘটতে দেখে শিক্ষায়, চাকরি-বাকরিতে নানা সুযোগ পেতে দেখে প্রথমে খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে, গরিব খ্রিস্টানদের দলিত মর্যাদা দিতে হবে। তা দেওয়া হয়েছে। এবার দাবি উঠেছে, মুসলমানদের মধ্যেও গরিবদের দলিতদের মতো সমমর্যাদা দিতে হবে। এই দাবি প্রথমে তোলে কংগ্রেস। এখন সব দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেছে, কারা মুসলমানদের কত বেশি সুবিধা, সুযোগ দিতে পারে তা দেখানো। কংগ্রেস বলছে, তারা মুসলমানদের জন্য ৯ শতাংশ চাকরি-বাকরি সংরক্ষণ রাখতে চায়। শিক্ষাক্ষেত্রে ৯ শতাংশ আসনও মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে বলে তারা জানিয়েছে। মুসলমানদের মন পাওয়ার প্রতিযোগিতায় সবাইকে টেক্কা দিতে চায় সমাজবাদী পার্টি। তারা তাদের ইশতেহার এখনও বাজারে ছাড়েনি। তবে নেতারা দাবি করছেন।
'আমরা মুসলমানদের এমন সব সুযোগ দেব যে, রাহুল গান্ধীও তা কল্পনায় আনতে পারবেন না। তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে। কী সেসব সুযোগ তা এখনও ঝেড়ে কাশেননি তারা। তবে তারা গরিব চাষিদের জন্য কী কী করবেন তার আভাস দিয়েছেন। যেমন সেচের জন্য আর তাদের পয়সা লাগবে না। সস্তায় বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। বেকার ভাতা দেওয়া হবে। বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়া হবে। আরও কত কী! কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টি মুসলিম কোটা বাড়ানোর জন্য যখন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট টানতে চাইছে, তখন একমাত্র বিজেপিই এই মুসলিম কোটার বিরুদ্ধে প্রচার করছে। তারা উমা ভারতীকে এই প্রচারের ভার দিয়েছে। দলিত ও বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন চিহ্নিত জাত। তাদের জন্যও কোটা আছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময় মণ্ডল কমিশন গঠন করা হয়। তিনি অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণীকে চিহ্নিত করেন। মজার কথা হলো, ব্রাহ্মণদের মধ্যেও কয়েক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ পশ্চাৎপদ বলে চিহ্নিত হয়েছে।
উমা ভারতী ওবিসি ও দলিতদের বলছেন, মুসলিম কোটা প্রবর্তিত হলে এখন যে সংরক্ষিত কোটা আছে তাদের মধ্য থেকেই মুসলমান কোটা (প্রস্তাবমতো ৪ শতাংশ) হবে। এতে দলিত তফসিলি জাত ও দলিতদের তেমন ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে ওবিসিদের। কারণ তাদের কোটা থেকেই মুসলমানদের ভাগ দেওয়া হবে।
তবে এত কিছুর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন, ভোটের আগে এসব ঘোষণা চলবে না। বিধানসভার ভোট যাতে বেআইনিভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা না হয় সে জন্য নির্বাচন কমিশন খুব সতর্ক। মায়াবতী তার রাজ্যের কতটা উন্নতি করেছেন_ তার ফিরিস্তি দিয়ে পুরো ভারতের খবরের কাগজে কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ভোট ঘোষণার আগে। উন্নয়ন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মায়াবতী একটা কাজ করেছেন, সারাদেশে তার তুলনা নেই। তিনি উত্তর প্রদেশজুড়ে তার নিজের ১৫৬টি স্ট্যাচু বসিয়েছেন। এর মধ্যে লখ্নৌতে তার ২৪ ফুটের একটি স্ট্যাচু আছে। আর ৫৬টি শ্বেতপাথরের হাতি বসানো হয়েছে বিভিন্ন পার্কে। হাতি বিএসপির নির্বাচনী প্রতীক। লখ্নৌ হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব স্ট্যাচু ও হাতিগুলোকে ঢেকে ফেলতে হবে। গত ক'দিন ধরে কাঠের বড় বড় ফ্রেম করে প্লাইউড বোর্ড দিয়ে সেসব মূর্তি ঢাকা হয়েছে।
ইউপিএ নির্বাচনে চিত্রতারকা আমির খানও নেমে পড়েছেন। না, তিনি ভোটে প্রার্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছেন না। আমিরের একটি সংস্থা আছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিআর)। তিনি ইউপিএর ৪ লাখ ও উত্তরা খণ্ডের ১ লাখ, পাঞ্জাবের ১ লাখ মানুষের উপযোগী একটি অভিনব পরিসেবা উপহার দিচ্ছেন। যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিশেষ প্রার্থী সম্পর্কে জানতে চান লোকটা কেমন, তার বিরুদ্ধে অপরাধের ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে কি-না, তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারবেন। কারণ বর্তমান বিধানসভায় ২০৬টি আসনের মধ্যে বিএসপির ৭৩ জন বিধায়কের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে। ৩৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। ২০১২ নির্বাচনে কংগ্রেসের ২৬ জন কলঙ্কিত রাজনীতিক প্রার্থী পদ পেয়েছেন। তাদের মাত্র ২২ জন বিধায়ক ছিলেন গতবার। ৮ জনের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা ছিল। সমাজবাদী পার্টি এবার ১২ জন আসামিকে প্রার্থী করেছেন। বিজেপির ২৬ জন প্রার্থী এবার লড়ছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। ইউপিএতে ১২টি রাজনৈতিক দল। পেশিশক্তিতে সব দলই সমান সেখানে।
উত্তর প্রদেশের ভোটের এই ডামাডোলের মধ্যে যে যেমন পারছে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে তা জাতপাতই হোক আর সাম্প্রদায়িকতাই হোক। যেমন রাজস্থানের জয়পুরে সাহিত্য সম্মেলনে সালমান রুশদিকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে ভারতের মৌলবাদী সংগঠনগুলো জলঘোলা করতে শুরু করেছে। দেওবন্দের দারুল উলুম এ নিয়ে প্রথম প্রতিবাদ তোলে। রুশদি 'স্যাটানিক ভার্সেস' লিখে মুসলমানদের ধর্মে আঘাত দিয়েছেন। অতএব তাকে এই সাহিত্য সম্মেলনে যেন আমন্ত্রণ না জানানো হয়। ভারত সরকার যেন তাকে ভিসা না দেয়। এই দাবিতে এখন গলা মিলিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় নেতা, এমনকি হিন্দু লেখক চেতন ভগৎও।
একসময় ইরানের আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি রুশদিকে খতম করার ফতোয়া দেন। রুশদি বছরের পর বছর কড়া পাহারায় ইংল্যান্ডে বাস করছিলেন। ফতোয়া প্রত্যাহৃত হলে তিনি প্রকাশ্যে আসেন। তিনি আগে ভারতেও কয়েকবার এসেছেন। কিন্তু কোনোবারই কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি। তবে এবারের প্রতিবাদের কারণ বোঝা যায়_ ভোট। এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার রুশদিকে ভিসা না দেওয়ার দাবিকে আমল দেয়নি। কিন্তু প্রতিবাদ তীব্র হলে এবং তাতে কংগ্রেসের ভোটব্যাংকে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। ভোট ও জোটের দায়ে ভারত সরকার তসলিমা নাসরিনকেও পাকাপাকিভাবে ভারত বাসে অনুমতি দেয়নি। গণতন্ত্রে ভোটই শেষ কথা।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.