গাদ্দাফির মৃত্যু-অনাকাঙ্ক্ষিত মর্মান্তিক পরিণতি

লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কাঙ্ক্ষিত ছিল না এবং কোনোভাবে সমর্থনও করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীর সম্মিলিত অভিযানের ছত্রছায়ায় বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপোলি ও গুরুত্বপূর্ণ শহর বেনগাজির দখল নেওয়ার পরই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।


তিনি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা যে কেবলই সমর্থকদের চাঙ্গা রাখার কৌশল তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি। তিনি ক্যারিশমাটিক নেতা ছিলেন এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধও করতে পেরেছিলেন। বেদুইন সমাজের একজন হয়েও তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন, জননন্দিত ও আপামর মানুষের নয়নমণি হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে স্বৈরশাসকে পরিণত হয়ে তিনি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেন। জনগণ যে বিরুদ্ধে চলে গেছে সেটা তিনি আদৌ বুঝে উঠতে পারেননি এবং এ জন্য চেষ্টাও করেননি। তার নিজের এবং পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বিষয়টি জনগণ মেনে নেয়নি। তিনি বিশ্বের নানা স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ ছিল এবং তা অমূলক নয়। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকজন খুনিকে তিনি লিবিয়ায় শুধু আশ্রয় দেননি, তাদের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থনও জুগিয়েছেন বছরের পর বছর। তিউনিসিয়া ও মিসরের প্রবল গণজাগরণের ঢেউ যখন লিবিয়ায় আছড়ে পড়তে শুরু করে, তখন তিনি সংস্কারের পথ অনুসরণ না করে একগুঁয়ে বেদুইন গোষ্ঠী প্রধানের মতো স্রোতের বিরুদ্ধে চলেন এবং জনগণের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র তাক করেন, পরিণতিতে যা তারই পতন ডেকে আনে। কিন্তু বৃহস্পতিবার তো ন্যাটো সমর্থিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সেনাদের হাতে তিনি জীবিত অবস্থাতেই ধরা পড়েছিলেন। তাকে কেন তাৎক্ষণিক হত্যা করা হলো? ট্রানজিশনাল কাউন্সিল এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের নেতাদের দাবি : লিবিয়ায় একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ না করে গাদ্দাফিকে 'ক্রসফায়ারে' দেওয়ার ঘটনায় তাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এ কারণেই তেলসমৃদ্ধ এ দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে সংশয় ও শঙ্কা সৃষ্টি না হয়ে পারে না। গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে সে দেশের জনগণ রাজপথে নেমে এসেছিল। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, তারা কি জনগণের আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণে সচেষ্ট হবেন? সন্দেহ নেই যে এ কাজ কঠিন। মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশের অভিজ্ঞতাও কিন্তু একই ধরনের সতর্কবার্তা দিচ্ছে। মিসরে তাহরির স্কয়ার ও অন্যান্য এলাকার জনগণ দিনের পর দিন অবস্থান করে হোসনি মোবারকের তিন দশকের অপশাসনের অবসান ঘটিয়েছে, কিন্তু এখনও সেখানে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা নিরাপদ সড়ক ধরে চলছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে পদচ্যুত স্বৈরশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণের অভিযোগ উঠছে। লিবিয়ার শাসকরা নিশ্চয়ই এমন পথে চলবেন না যা জনগণকে হতাশ করে এবং দেশটিকে ফের অস্থিরতার পথে ঠেলে দেয়। স্বাধীনচেতা এ দেশটি ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মর্জিমাফিক পরিচালিত হবে, এটাও কিন্তু কাঙ্ক্ষিত হবে না।
 

No comments

Powered by Blogger.