‘আবেদিত’ ও একটি শব্দ! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
বেশ কিছুদিন পরে জাতীয় প্রেসক্লাবে গেলাম। একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার প্রয়োজনে এই যাওয়া।
সাংবাদিকদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এই প্রেসক্লাবের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। আমাদের জাতীয় জীবনে বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে অভিভাবকের ভূমিকা পালনকারী বরেণ্য কয়েকজন সাংবাদিক গভীর মমতায় একদা গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের মিলনক্ষেত্র।
সাংবাদিকদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এই প্রেসক্লাবের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। আমাদের জাতীয় জীবনে বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে অভিভাবকের ভূমিকা পালনকারী বরেণ্য কয়েকজন সাংবাদিক গভীর মমতায় একদা গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের মিলনক্ষেত্র।
ক্ষুদ্রাকারের সেই প্রেসক্লাব আজ বিশাল এক প্রতিষ্ঠান। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলে যার থাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
অনুজপ্রতীম মাহবুব হাসান সত্তরের অন্যতম উজ্জ্বল এক কবি। বাংলা সাহিত্যের এই কৃতী ছাত্র ডক্টরেট অর্জন করেও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মাহবুব হাসান আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকের তরফ থেকে। তরুণ প্রকাশক তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের প্রকাশনা উত্সবের আয়োজন করেছেন, জানালেন মাহবুব হাসান। আমার সম্মতি পেলে প্রকাশক আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাবেন, এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি।
সেই প্রসঙ্গ থাক। বরং বলি প্রেসক্লাবে আসার আগের অভিজ্ঞতার কথা।
যানজটে ঢাকা নগরী আজকাল প্রায়ই স্থবির হয়ে যায়, এমন খবর এখন আর বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। দিন দিন আরও দুঃসহ হচ্ছে এই অবস্থা।
প্রতিদিন রাজপথে নতুন নতুন গাড়ি নামছে। চকচকে নতুন গাড়ির কোনো কোনোটার গায়ে গ্যারেজের নম্বর প্লেট। কোনোটায় আবার শুধু লেখা ‘আবেদিত’। আবার কোনোটায় পুরোপুরি লেখা ‘এপ্লায়েড ফর রেজিসেল্ট্রশন’। আবার কোনোটায় শুধু তিনটি ইংরেজি ‘ক্যাপিটেল’ বর্ণ ‘এ এফ আর’ লেখা!
নম্বর প্লেটে এ ধরনের লেখাকে বর্তমানে রাজপথে দৃশ্যমান নৈরাজ্যকর অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে হয়!
ট্রাফিক আইন নাকি বলে রেজিসেল্ট্রশনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন না করে কোনো যানবাহন রাস্তায় নামানো দণ্ডনীয় অপরাধ। গ্যারেজ নম্বর নিয়ে গাড়ি রাজপথে যে দেদারছে চলছে, তা আইনের চোখে সিদ্ধ কোনো কাজ নয়। দু’একজন বলেন, দুই-তিনদিন নাকি গ্যারেজ নম্বর দিয়ে গাড়ি চালানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দুই-তিনদিনের প্রমাণ হবে কি করে?
সে না হয় আইনের দিকের জটিল প্রসঙ্গ। সাধারণ মানুষের জানার কথা নয় আইনের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার কথা। আমি বলছি ভাষার কথা। নম্বর প্লেটে ব্যবহৃত ভাষার কথা!
‘আবেদিত’ বলে নম্বর প্লেটে অহরহ ব্যবহৃত শব্দটির খোঁজ একাধিক অভিধান ঘেঁটেও পাইনি। অভিধানে ভুক্তি আছে ‘আবেদক’, ‘আবেদন’, ‘আবেদনীয়’—শব্দের; কিন্তু ‘আবেদিত’ নামক শব্দটির নেই। কিন্তু নেই ‘আবেদিত’ নামক কিম্ভূত শব্দটির।
ধারণা করি, কোনো অতিশয় ধূর্ত পণ্ডিত (!) শব্দটি আবিষ্কার করেছেন তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগ করে।
ইংরেজিতে যদি নম্বর প্লেটে নম্বর না থাকার কারণে ‘এপ্লায়েড ফর রেজিসেল্ট্রশন’ লেখা থাকে, তাহলে বুঝি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গাড়ির রেজিসেল্ট্রশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং সেই আবেদনের ফলাফল আবেদনকারী এখনও পেয়ে ওঠেননি। অতএব, আবেদনের ভিত্তিতে রাস্তায় গাড়ি বের করা দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না।
যিনি চেয়েছেন আবেদন করার তথ্যটি জানিয়ে নম্বর প্লেট তৈরি করে গাড়ি রাস্তায় বের করবেন, তাকে নম্বর প্লেটে লিখতে হচ্ছে : ‘রেজিসেল্ট্রশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে’ জাতীয় কিছু; কিন্তু ক্ষুদ্র নম্বর প্লেটে এতগুলো শব্দের স্থান সঙ্কুলান হওয়া কষ্টকর। সাধারণত, এ জাতীয় তথ্যসম্বলিত প্লেটের বদলে পিচ বোর্ড, হার্ডবোর্ড জাতীয় কিছু ব্যবহার করা হয়। যেহেতু পুরো কাজটি করা হয় হেলাফেলায়, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হেলাফেলার ব্যাপারটি লক্ষণীয়।
যদি লেখা হতো ‘আবেদনকৃত’, তা হলেও একটা অর্থ বোঝা যেত সহজে। কিন্তু ‘আবেদিত’ শব্দটির কোনো অর্থ হয় বলে আমার তো মনে হয় না। ব্যাকরণে আমার জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। ব্যাকরণের সূত্র মেনে শুদ্ধ বাক্য, শুদ্ধ শব্দ তৈরি করার জ্ঞান আমার না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘আবেদিত’ নামক শব্দটি কোনো অর্বাচীনের উর্বর মাথা থেকে সৃষ্টি হয়েছে!
যিনি প্রথম এই শব্দটি অপসৃষ্টি করেছেন, তিনি অনেক বড় লেখকের মতো বলতে পারেন, ব্যাকরণ তিনি জানেন না।
বড় লেখকদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় উক্তিকে বিনয় বলে মনে করা হলেও, এই অর্বাচীন ব্যক্তির ক্ষেত্রে তেমন মনে করার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই এবং ধারণা করি, এমন সত্য কথন কদাচ তাকে দিয়ে সম্ভব হবে না।
বিদ্যাসাগরের কাছে দুরবস্থায় নিপতিত ব্যক্তি সাহায্য প্রার্থনা করে তার ‘দুরাবস্থার’ কথা বললে, বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তা যে তিনি পড়েছেন, ‘আকার’ দেখেই বোঝা যায়।
প্রেসক্লাবে কার পার্কিং লটে ‘আবেদিত’ একটি গাড়ি দেখে তার মালিককে বলতে চেয়েছিলাম, মহাশয়, বিত্ত অর্জন সহজ হতে পারে তবে বিদ্যা অর্জন সহজ নয়।
শব্দ তৈরি করতে গিয়ে কেউ যদি নৈরাজ্যকর কিছু করে, তাকে প্রতিহত করা প্রয়োজন।
‘আবেদিত’ শব্দটি যখন কোনো নামকরা প্রতিষ্ঠানের আনকোরা নতুন গাড়িতে দেখি, ক্ষুব্ধ হই দ্বিগুণ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
অনুজপ্রতীম মাহবুব হাসান সত্তরের অন্যতম উজ্জ্বল এক কবি। বাংলা সাহিত্যের এই কৃতী ছাত্র ডক্টরেট অর্জন করেও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মাহবুব হাসান আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকের তরফ থেকে। তরুণ প্রকাশক তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের প্রকাশনা উত্সবের আয়োজন করেছেন, জানালেন মাহবুব হাসান। আমার সম্মতি পেলে প্রকাশক আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাবেন, এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি।
সেই প্রসঙ্গ থাক। বরং বলি প্রেসক্লাবে আসার আগের অভিজ্ঞতার কথা।
যানজটে ঢাকা নগরী আজকাল প্রায়ই স্থবির হয়ে যায়, এমন খবর এখন আর বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। দিন দিন আরও দুঃসহ হচ্ছে এই অবস্থা।
প্রতিদিন রাজপথে নতুন নতুন গাড়ি নামছে। চকচকে নতুন গাড়ির কোনো কোনোটার গায়ে গ্যারেজের নম্বর প্লেট। কোনোটায় আবার শুধু লেখা ‘আবেদিত’। আবার কোনোটায় পুরোপুরি লেখা ‘এপ্লায়েড ফর রেজিসেল্ট্রশন’। আবার কোনোটায় শুধু তিনটি ইংরেজি ‘ক্যাপিটেল’ বর্ণ ‘এ এফ আর’ লেখা!
নম্বর প্লেটে এ ধরনের লেখাকে বর্তমানে রাজপথে দৃশ্যমান নৈরাজ্যকর অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে হয়!
ট্রাফিক আইন নাকি বলে রেজিসেল্ট্রশনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন না করে কোনো যানবাহন রাস্তায় নামানো দণ্ডনীয় অপরাধ। গ্যারেজ নম্বর নিয়ে গাড়ি রাজপথে যে দেদারছে চলছে, তা আইনের চোখে সিদ্ধ কোনো কাজ নয়। দু’একজন বলেন, দুই-তিনদিন নাকি গ্যারেজ নম্বর দিয়ে গাড়ি চালানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দুই-তিনদিনের প্রমাণ হবে কি করে?
সে না হয় আইনের দিকের জটিল প্রসঙ্গ। সাধারণ মানুষের জানার কথা নয় আইনের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার কথা। আমি বলছি ভাষার কথা। নম্বর প্লেটে ব্যবহৃত ভাষার কথা!
‘আবেদিত’ বলে নম্বর প্লেটে অহরহ ব্যবহৃত শব্দটির খোঁজ একাধিক অভিধান ঘেঁটেও পাইনি। অভিধানে ভুক্তি আছে ‘আবেদক’, ‘আবেদন’, ‘আবেদনীয়’—শব্দের; কিন্তু ‘আবেদিত’ নামক শব্দটির নেই। কিন্তু নেই ‘আবেদিত’ নামক কিম্ভূত শব্দটির।
ধারণা করি, কোনো অতিশয় ধূর্ত পণ্ডিত (!) শব্দটি আবিষ্কার করেছেন তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগ করে।
ইংরেজিতে যদি নম্বর প্লেটে নম্বর না থাকার কারণে ‘এপ্লায়েড ফর রেজিসেল্ট্রশন’ লেখা থাকে, তাহলে বুঝি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গাড়ির রেজিসেল্ট্রশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং সেই আবেদনের ফলাফল আবেদনকারী এখনও পেয়ে ওঠেননি। অতএব, আবেদনের ভিত্তিতে রাস্তায় গাড়ি বের করা দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না।
যিনি চেয়েছেন আবেদন করার তথ্যটি জানিয়ে নম্বর প্লেট তৈরি করে গাড়ি রাস্তায় বের করবেন, তাকে নম্বর প্লেটে লিখতে হচ্ছে : ‘রেজিসেল্ট্রশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে’ জাতীয় কিছু; কিন্তু ক্ষুদ্র নম্বর প্লেটে এতগুলো শব্দের স্থান সঙ্কুলান হওয়া কষ্টকর। সাধারণত, এ জাতীয় তথ্যসম্বলিত প্লেটের বদলে পিচ বোর্ড, হার্ডবোর্ড জাতীয় কিছু ব্যবহার করা হয়। যেহেতু পুরো কাজটি করা হয় হেলাফেলায়, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হেলাফেলার ব্যাপারটি লক্ষণীয়।
যদি লেখা হতো ‘আবেদনকৃত’, তা হলেও একটা অর্থ বোঝা যেত সহজে। কিন্তু ‘আবেদিত’ শব্দটির কোনো অর্থ হয় বলে আমার তো মনে হয় না। ব্যাকরণে আমার জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। ব্যাকরণের সূত্র মেনে শুদ্ধ বাক্য, শুদ্ধ শব্দ তৈরি করার জ্ঞান আমার না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘আবেদিত’ নামক শব্দটি কোনো অর্বাচীনের উর্বর মাথা থেকে সৃষ্টি হয়েছে!
যিনি প্রথম এই শব্দটি অপসৃষ্টি করেছেন, তিনি অনেক বড় লেখকের মতো বলতে পারেন, ব্যাকরণ তিনি জানেন না।
বড় লেখকদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় উক্তিকে বিনয় বলে মনে করা হলেও, এই অর্বাচীন ব্যক্তির ক্ষেত্রে তেমন মনে করার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই এবং ধারণা করি, এমন সত্য কথন কদাচ তাকে দিয়ে সম্ভব হবে না।
বিদ্যাসাগরের কাছে দুরবস্থায় নিপতিত ব্যক্তি সাহায্য প্রার্থনা করে তার ‘দুরাবস্থার’ কথা বললে, বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তা যে তিনি পড়েছেন, ‘আকার’ দেখেই বোঝা যায়।
প্রেসক্লাবে কার পার্কিং লটে ‘আবেদিত’ একটি গাড়ি দেখে তার মালিককে বলতে চেয়েছিলাম, মহাশয়, বিত্ত অর্জন সহজ হতে পারে তবে বিদ্যা অর্জন সহজ নয়।
শব্দ তৈরি করতে গিয়ে কেউ যদি নৈরাজ্যকর কিছু করে, তাকে প্রতিহত করা প্রয়োজন।
‘আবেদিত’ শব্দটি যখন কোনো নামকরা প্রতিষ্ঠানের আনকোরা নতুন গাড়িতে দেখি, ক্ষুব্ধ হই দ্বিগুণ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
No comments