ভূমিমাতার বরপুত্র সেলিম আল দীন by আলমগীর মাসুদ

চারদিক মাতামাতি চলছে চাকার কাহিনী, ১৪ জানুয়ারি হঠাৎ নিভে গেছে প্রদীপ। ভূমিমাতার বরপুত্র আচার্য সেলিম আল দীন আমাদের সবাইকে এতিম করে চলে গেছেন, ওপারে... হ্যাঁ, সত্যি সত্যি ওপারে চলে গেছেন। ১৪ জানুয়ারি তারপর ৯, ১০, ১১ আজ আবার ফিরে এসেছে ২০১২, ১৪ জানুয়ারি সেই দিনক্ষণ। আমরা হারিয়েছি এই দিনটিতে আমাদের পিতামহী গুরুজনকে। আমরা তো কিছুই শিখিনি, পাইনি গুরুজির সংস্পর্শ। তারপর যাত্রাপথেই কেমন জানি ভাগ্য,


আমাদের পেছনে ধাবিত করেছে। হাসি-কান্না, দীর্ঘ আর্তনাদ... তারপর শোকে শোকে নিস্তব্ধ। হ্যাঁ, তিনি সেই মহামানব যার চোখে ছিল অপার গোটা বিশ্ব...। পৃথিবীর মানবকে গড়ে তুলবে সুসং ইস্পাতে, জানার পরিধি ঘটাবে বিশ্বময়। অতঃপর তিনি নিজে হারিয়ে যাবেন কখনও কি ভেবেছি? না, এ হয়তো কল্পনায়ও আসেনি। মিথ্যাকে কল্পনা করাও তো মহাপাপ! তারপর হাসিরেখা এক জ্বলন্ত সিগারেটের মতো তিনিও যে হারিয়ে যাবেন তা ভেবেছিল ক'জন। সময়ের ঘরে মাঝে মাঝে মনটা খানিক অশান্ত হয়ে ওঠে। যখন দেখি স্যারের মৃত ছবি আমার পড়ার টেবিলে। দু'চোখে তাকিয়ে আছে_ পৃথিবী ও আমরা কত অসহায়! আসলে সেই সময়টাই বারবার ফিরে আসে। যখন স্যারকে দেখি মেঘমুক্ত খোলা আকাশের নিচে। দুই পকেটে আনমনে দু'হাত রেখে হাঁটতে। কত সময় লুকিয়ে গেছি স্যারের দু'চোখের দৃষ্টি থেকে। আজ সবকিছুই বুঝি হৃদয়ের সশস্ত্র প্রচার। যেমন_ মৃত্যুবার্ষিক.. তারপর জন্ম...। কিছু দূর থেকে স্যার দেখবেন অসহায় বালক হয়ে, হয়তো ওই দূরের যাত্রায় স্যারের সঙ্গী কেউ নেই। একাঙ্গিক একা খুব একা মত্ত হয়ে দেখবেন
আমাদের কার্যকলাপ। তারপর চাকায় পিষ্ট হয়ে আমাদেরও তো হারিয়ে যেতে হবে জীবন জয়যাত্রার পথে। কখনও আলোহীন সূর্যটা আমাদেরও আঁধারে নিক্ষেপ করবে...।
দুই.
স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমার চোখ দুটো অশ্রুতে ভিজে গেছে। তারপর সত্যি সত্যি চোখ দুটো মুছতে মুছতে জানতে পারলাম, এই প্রথম আমার চোখ দুটো কোনো এক দিবালোকে আনমনে শোকে গোপনে দীর্ঘ সময় ধরে বেদনার অশ্রু ঝরাল। এ পর্যন্ত আমি কত মৃত্যু দেখেছি, অতঃপর মৃত্যুগুলো আমায় দিয়েছে কান্না। অতএব, মৃত্যুকে চাই না বলে আমার এই লেখা। স্যার, তুমি ফিরে এসো, বহমান এক নদীর স্রোতে আমরা অবিরত ভাসছি। তুমি এসে তোমার শক্ত হাতে আমাদের উঠিয়ে তোল। তোমার দু'চোখের আলো দেখে আমরা যেন আবার আলোকিত সূর্য খুঁজে পাই। তারপর আঁধার কেটে আমরা যেন তোমার সংস্পর্শে আগামীর হাজার বছর চলার প্রেরণা পাই। তারপর তুমিও তো এক মহাকেন্দ্র খুলেছ। একেক কেন্দ্রে একেক দর্শন নিয়ে সহজে তুমি হাজির। তোমার বিচরণ ঘটেছে একেক মহাকাব্যে। তারপর তোমার সৃষ্টি মহুয়া ফুলের উৎসব। এই আনন্দময় দিনক্ষণে তুমি কয়েক বছর থাকলেও অথচ আজ নিবিড় হাজার বছরের জন্য হারিয়ে গেছো তুমি। তুমি তোমার কালজয়ী সৃষ্টিকে খানিক উপলব্ধি করলেও আমরা বরাবরই ভাবান্দোলিত হই, এই ভেবে, কেমন করে তুমি পৃথিবীর কঠিনকে তোমার তরে সহজ করে সৃষ্টি করেছ! যা হওয়ার নয়, তাই যখন ঘুরেফিরে অসময়ে নিজ ঘরে বন্দি, আমাদের আপন সত্তাকে হারিয়ে আজ আমরা কত অসহায়। জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে মনে পিপাসা জাগে। স্যার, তুমি কোথায়...? জীবনকে কর্মময় ক্ষেত্রে ধাবিত করতে পারি না। আজ শুধুই বেদনা, শোক, অশ্রুতর কণ্ঠে আর্তচিৎকার। আর দিবাগত স্বপ্নলোকের শুধুই অপূর্ণতা। জীবনকে স্বপ্ন কাঠির সন্ধানে তাড়া করলেও পেছনে থাকাতে মনে পড়ে ৭ জানুয়ারি-১৪ জানুয়ারি বারডেম, ল্যাব-এইড কার্ডিয়াকের কথা। যেখানে তুমি দীর্ঘ ১৬৮ ঘণ্টা ঘোর অন্ধকারে চোখ বুজে একা পৃথিবীর স্বপ্ন কেন্দ্রে শুয়ে ছিলে...। তারপর যখন সারা পৃথিবী তোমার ভক্তময় জেনে গেছেন, স্যার চলে গেছেন অজানা স্থানে...। না ফেরার দেশে সহজে চলে গেছেন, স্যার। তারপর কত অশ্রু সিক্ত, উৎকণ্ঠে মানুষের নীরবতা। খানিক এই অধমকেও ভাবনায় ফেলেছে। এই বুঝি স্যার, এত জনপ্রিয়। এই মৃত মানুষটাকে হাজার হাজার শ্রদ্ধা। হাজার হাজার মানুষের শোকসভা। দেশে প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি কাগজে স্যারের এই অসময়ে চলে যাওয়ার প্রতি সশ্রদ্ধায় বেদনাবিধুর ও স্মৃতিচারণ। তারপরও কি মানুষ ভুলে গেছে? না, স্যার মরে গিয়েও যেন বাস্তব সত্য_ এই শিশুসুলভ মানুষটি আরও দ্বিগুণ জনপ্রিয় এবং মানুষের হৃদয়ে বন্দি হয়েছেন। না জানা মানুষকে তার মৃত্যুকে উপলব্ধি করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, একজন সেলিম আল দীন কতটা নিখুঁত পরিমাণ বন্ধু ও শ্রদ্ধাভাজন :সেই সঙ্গে একাঙ্গিক শিক্ষাগুরু থেকে একজন সত্যিকার সৃষ্টিশীল মানুষ বটে। স্যার, আজ তুমি ঘুমিয়ে থাক, ঘুমপাড়ানি মাসির কোলে। তোমার ফেলে যাওয়া অপূর্ণ কাজ আজ আমাদের ওপর। আমরা যেন পাড়ি দিতে পারি তোমার হাজার বছরের রেখে যাওয়া কাজকে, আগামীর আলো দেখাতে। তুমি ঘুমিয়ে থাক শক্ত মাটির কোলে, প্রার্থনায় প্রার্থনায় তুমি যুগ যুগ ফিরে আসবে...।
হসুহৃদ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.